প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজকের বাংলাদেশ আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ। সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বব্যাংক মডেল হিসেবে বিশ্বব্যাপী উপস্থাপন করছে। গতকাল সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের টানা দ্বিতীয়বার মতো সরকার গঠনের তৃতীয় বর্ষপূর্তিতে তিনি এ ভাষণ দেন।
প্রধানমন্ত্রী ভাষণে গত আট বছরে তার সরকারের সময়ে নেওয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেন। এ ক্ষেত্রে তিনি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিভিন্ন সূচকের ইতিবাচক ধারা উল্লেখ করেন। একই সঙ্গে তিনি বিদ্যুত্ উত্পাদন, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী, যোগাযোগ, নৌপরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি খাতে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। কতটুকু প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে তার বিচারের ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটুকু দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, দেশের ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য আমরা চেষ্টার ত্রুটি করিনি।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ কথায় নয়, কাজে বিশ্বাস করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা থেকে শুরু করে দেশের যত উল্লেখযোগ্য অর্জন, তার সবগুলো এনেছে আওয়ামী লীগ। সব বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে দেশকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এ ক্ষেত্রে তিনি দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নে নিয়োজিত করার আহ্বান জানান। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আশা করি, সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির উদ্যোগে গঠিত নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখবেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশ নেবেন এবং দেশে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে সহায়তা করবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চলতি মেয়াদের তিন বছর অতিক্রম করলাম। আমাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
একটি গোষ্ঠী ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশে অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার অপচেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, তবে ধর্মান্ধ নয়। হাজার বছর ধরে এ দেশের মাটিতে সব ধর্মের মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তিতে বসবাস করে আসছেন। যারা এই ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়, তাদের ঠাঁই বাংলার মাটিতে হবে না। তিনি দেশের সব ইমাম, মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, স্থানীয় মুরব্বি, আনসার-ভিডিপি সদস্য এবং অভিভাবককে জঙ্গি তত্পরতার বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। সন্তানের প্রতি নজর রাখার জন্য অভিভাবকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের এমনভাবে পরিচালিত করুন, যাতে তারা ভুলপথে পা না বাড়ায়।’ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপিকে সংবিধানের আওতায় সব ধরনের ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নেতৃত্ব সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। বরং উনি সন্ত্রাসীবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেন। পেট্রলবোমা, অগ্নিসংযোগ ও বোমা হামলা করে মানুষ হত্যায় মেতে উঠলেন। শতাধিক মানুষ হত্যা করলেন। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করলেন। তিনি বলেন, বিএনপি জোট নির্বাচন বর্জন করলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দল এবং প্রার্থীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সুষ্ঠুভাবে ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচন হয়। নির্বাচনের সময় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নির্বাচন কমিশনের অধীনে ছিল। সরকার কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি। তিনি বলেন, ৯২ দিন পার্টি কার্যালয়ে আরাম-আয়েশে অবস্থান করে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের নামে বিএনপি নেত্রী আবার জ্বালাও-পোড়াও-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উসকে দেন। এ তিন মাসে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের হাতে ২৩১ জন নিরীহ মানুষ নিহত এবং ১ হাজার ১৮০ জন আহত হন। দেশবাসী তাদের এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রত্যাখ্যান করেছেন।শেখ হাসিনা তার সরকারের সময়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ ৫টি দেশের একটি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকারও বেশি, যা জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বে ৪৪তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩২তম। জনগণের মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালের ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে আজ ১ হাজার ৪৬৬ ডলার হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৫-০৬ সালে ছিল ৪১.৫ শতাংশ। এখন তা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২২.৪ শতাংশ। অতি দারিদ্র্যের হার ২৪.২৩ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বিদ্যুত্ উত্পাদন ছিল ৩ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুত্ উত্পাদন প্রায় ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুত্ সুবিধার আওতায় এসেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ এখন খাদ্য-উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে। মিঠা পানির মাছ উত্পাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ এবং সবজি উত্পাদনে তৃতীয় স্থানে। তিনি বলেন, ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব বিদ্যালয়ের ১ লাখ ২০ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারি করা হয়েছে। যেসব উপজেলায় সরকারি স্কুল বা কলেজ নেই, সেসব উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণ করা হবে। যেসব জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় নেই, সেসব জেলায় একটি করে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নের নানা দিক বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাতৃমৃত্যু প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৮ জনে এবং শিশুমৃত্যু ২৯ জনে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৯ সালে দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ছিল ১৪টি যা বর্তমানে ৩৬টিতে উন্নীত হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি মিলে ডেন্টাল কলেজের সংখ্যা ২৮টি। কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের ঐকান্তিক আগ্রহ এবং নিরলস প্রচেষ্টায় অটিজম সমস্যা বিশ্বসমাজের দৃষ্টিতে আনা সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অটিস্টিক শিশুদের সুরক্ষায় ২২টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
অচিরেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ১ লাখ পরিবারের মধ্যে স্বাস্থ্যকার্ড বিতরণ করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নৌ খাতে উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চারটি অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা ও বরিশাল নদীবন্দরকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। কাঁচপুর, সন্দ্বীপ ও কুমিরায় নৌযানের ল্যান্ডিং সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এক সময়ের মৃতপ্রায় মংলাবন্দর আমাদের সরকারের সময়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতুর অপর প্রান্তে মাদারীপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণের সমীক্ষার কাজ শিগগিরই শুরু হবে।