নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ অব্যাহত রয়েছে। এখন অপেক্ষা সার্চ কমিটি গঠনের। কমিশন গঠনে ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ২৩ দলের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। আগামী সপ্তাহে আরও আট দলের সঙ্গে সংলাপে বসার কথা রয়েছে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী সব দলের প্রত্যাশা, রাষ্ট্রপতির এ সংলাপ হবে কার্যকর ও ফলপ্রসূ। সবাই ফলাফলের অপেক্ষায়।
জানা গেছে, সার্চ কমিটি গঠনের বিষয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২৪ জানুয়ারির মধ্যে এ কমিটি গঠিত হতে পারে। এরপর নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নাম খোঁজার কাজ করবে সার্চ কমিটি। এ ক্ষেত্রে তারা মাত্র দুই সপ্তাহ সময় পাবেন। এদিকে কারা আসছেন নতুন নির্বাচন কমিশনে, তা নিয়ে সর্বত্র চলছে আলাপ-আলোচনা। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বর্তমান কমিশনের বিদায়ের পর দায়িত্ব নেবে নতুন নির্বাচন কমিশন। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতিমধ্যে এ নির্বাচনে ই-ভোটিং চালুর প্রস্তাব করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া তারা ইসি গঠনে আইন করারও প্রস্তাব করেছে। যদিও গতকাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, এ আইনটা ঝটপট তৈরি করা যায় না। এর একটা সুদূরপ্রসারী ইফেক্ট আছে। সে কারণে এ আইনটা চিন্তাভাবনা করে করা উচিত। সে ক্ষেত্রে আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির নির্দেশনার অপেক্ষা করছি।’
বর্তমান ইসি নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এবার নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্কে জড়াতে চাইছে না সরকার। ক্লিন ইমেজের লোকদের ইসিতে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে বিএনপিসহ অনেক দল তাদের পছন্দের ‘নির্বাচন কমিশনারদের’ নামের তালিকা দিয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি ‘নির্বাচন কমিশনার’ হতে পারেন এমন ১০ জনের নাম প্রস্তাব করার পাশাপাশি সার্চ কমিটিতে কারা থাকবেন তাদের নামও রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ আছে মাত্র ২৬ দিন। ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখে বিদায় নেবেন তারা। আসবে নতুন কমিশন। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এজন্য রাজনৈতিক দলের মতামত নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। এর আগেও ২০১২ সালে ইসি নিয়োগের ১৪ দিন আগে সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। জানা গেছে, সার্চ কমিটি গঠনের পর যেসব দল ‘নতুন কমিশনের’ জন্য নাম প্রস্তাব করেনি, তাদের কাছে আবারও নামের তালিকা চাওয়া হতে পারে। এরপর সব দলের প্রস্তাবিত নাম এবং কমিটি অনুসন্ধান করে রাষ্ট্রপতির কাছে নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নাম সুপারিশ করবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে সংবিধানে আইন প্রণয়নের কথা থাকলেও গত চার দশকেরও বেশি সময়ে তা আর হয়ে ওঠেনি। এবার সেই ঝুলে থাকা আইন প্রণয়নের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর আগে নির্বাচন কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়ার বিধান রাখার প্রস্তাব এসেছিল বিভিন্ন মহল থেকে।সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দান করিবেন।’ আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারও আগের প্রক্রিয়ায় ইসি নিয়োগ হবে। ২০১২ সালে যেভাবে বর্তমান ইসি গঠন করা হয়েছিল, এবারও সেভাবেই হবে। রাষ্ট্রপতি যথাসময়ে সংবিধান অনুসারে ইসি নিয়োগ দেবেন।
২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নামের সুপারিশ তৈরি করতে চার সদস্যের সার্চ (অনুসন্ধান) কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতিকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য হন হাই কোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান। এর আগে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অধিকাংশ দলই সার্চ কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছিল। ইসি গঠন নিয়ে ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ ২৩টি দলের মতামত নেন রাষ্ট্রপতি। এ সংলাপে অধিকাংশ দলই সংবিধান অনুসারে সিইসি ও ইসি নিয়োগে আলাদা আইন করা বা অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে মত দেয়। সার্চ কমিটির আহ্বানে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল নতুন কমিশনের জন্য তাদের পছন্দের ব্যক্তির নামের তালিকা দিলেও বিএনপি কোনো নাম দেয়নি। ওই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে যে সুপারিশ জমা দেয়, তাতে সিইসি ও চার কমিশনার নিয়ে পাঁচ পদের জন্য ১০টি নাম আসে। এর মধ্য থেকেই পাঁচজনকে বেছে নেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির আদেশের পর ২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরদিন প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিয়েই তারা যোগ দেন ইসিতে।
ইসিতে কারা আসছেন : নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। এ নিয়ে সরগরম হয়ে উঠছে রাজনীতির মাঠও। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। চায়ের টেবিল থেকে হাট-বাজার সবখানেই একই আলোচনা। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্কে জড়াতে চাইছে না সরকারও। ক্লিন ইমেজের লোকদের ইসিতে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে এমন বেশ কয়েকজন ব্যক্তির নাম এ তালিকায় উঠে এসেছে। একই সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ভিসি ও কয়েকজন সাবেক সচিবের নামও আছে এ তালিকায়। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী অধ্যাপকের নামও আলোচনায় রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পুনর্গঠিতব্য পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনে অন্তত একজন নারী কমিশনার রাখার পক্ষে নানা মহল থেকে দাবি আসছে। রাজনৈতিক দল, সরকারি-বেসরকারিসহ নানা পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নের চলমান প্রক্রিয়ায় যোগ্যদেরও ইসিতে স্থান দেওয়ার পক্ষে আসছে এমন মত।
আরও আট দলকে আমন্ত্রণ : নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন নিয়ে আলোচনার জন্য পঞ্চম দফায় আরও আটটি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। দলগুলো হলো— বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), গণফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) ও গ্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি)। গতকাল রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, আমন্ত্রিত দলগুলোর সঙ্গে ১৬, ১৭ ও ১৮ তারিখ আলোচনা করবেন রাষ্ট্রপতি। নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে ১৮ ডিসেম্বর সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির সঙ্গে প্রথম আলোচনায় বসেন রাষ্ট্রপ্রধান। সব মিলিয়ে চার দফায় বিএনপি, আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, এলডিপি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, সিপিবি, বাসদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ মোট ২৩টি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ হয়।