বাংলাদেশে তিন দিনের সফর শেষ করে গতকাল দেশে ফিরে গেছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির বিশেষ দূত ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী উ চ থিন। তার এ সফরে রাখাইন রাজ্যে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে এনে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান জনগোষ্ঠীর গণহারে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান ও মূল সমস্যা সমাধান করতেও বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি কর্মকৌশল নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে সব বিষয়ে আলোচনা করে সমাধানের আগ্রহ দেখানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে গত দুই মাসে বাংলাদেশে প্রবেশ করাদের পরিচয় নিশ্চিত সাপেক্ষে ফেরত নেওয়ার কথা বলে মিয়ানমার। সফর শেষে গতকাল ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। মন্ত্রণালয়ে আনক্লজ সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, মিয়ানমারের বিশেষ দূত উ চ থিন সে দেশের নতুন সরকারের বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও সহযোগিতা গভীরতর করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য স্টেট কাউন্সিলর সু চির বিশেষ আগ্রহের কথা উল্লেখ করেন। তিনি আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর ও সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের আগ্রহের কথা তুলে ধরেন। বিশেষ দূত গত ৯ অক্টোবর ২০১৬ এর সীমান্ত ফাঁড়িতে সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশের ভূমিকা ও সহযোগিতার প্রশংসা করেন। মিয়ানমারের গণমাধ্যমে ৯ অক্টোবর সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিতপূর্ণ সংবাদ প্রকাশের বিষয়ে বিশেষদূত উল্লেখ করেন, মিয়ানমার সরকার কখনো বাংলাদেশকে দোষারোপ করেনি। তিনি সীমান্ত ব্যবস্থাপনাসহ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মিয়ানমারের নতুন সরকার রাখাইন রাজ্যে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানে কফি আনান কমিশন গঠনসহ অনেক উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানান। বৈঠককালে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়। তাছাড়া জটিল বিষয়গুলোতে ইতিবাচক ও আন্তরিক আলোচনার আহ্বান জানানো হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানান, বাংলাদেশের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন প্রত্যাশীদের মিয়ানমার নাগরিক বা স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার বিষয়টি যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে। মিয়ানমার প্রাথমিকভাবে গত দুই মাসে রাখাইন রাজ্য হতে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারীদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে তাদের নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার দাবি যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শুরুর আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ মিয়ানমারের নিবন্ধিত শরণার্থী, অনিবন্ধিত এবং নতুন আগত মিয়ানমার নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে একই সঙ্গে উদ্যোগ নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে। প্রত্যাবাসনকে কার্যকর এবং টেকসই করার জন্য রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা ও টেকসই জীবিকার সুযোগ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়, যাতে প্রত্যাবাসনকারী নিজ ভূমিতে নিরাপত্তা ও সম্মানসহ স্বাভাবিক জীবিকা অর্জনের সুযোগ পায়। এ ছাড়াও রাখাইন মুসলিমদের প্রান্তিকীকরণ (সধত্মরহধষরুধঃরড়হ) রোধ ও তাদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। অন্যথায় প্রত্যাবাসনকারী সংখ্যালঘুরা পুনরায় ফিরে আসতে পারে বলে বাংলাদেশ মত প্রকাশ করে। এ বিষয়ে সমন্বিত ও সামগ্রিক কর্মপন্থা নির্ধারণের প্রস্তাব করে বাংলাদেশ। দুই পক্ষই এ বিষয়ে অনতিবিলম্বে আলোচনা করতে সম্মত হয়। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকসহ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিয়ানমারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। এসব আলোচনায় বাংলাদেশ গত ৯ অক্টোবর ২০১৬’র ঘটনার পর হতে বিপুলসংখ্যক মিয়ানমার নাগরিকের বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে প্রায় ৬৫ হাজার মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণ করেছে এবং অনুপ্রবেশের ধারা অব্যাহত রয়েছে বলে বিশেষ দূতকে অবহিত করা হয়। বিপুলসংখ্যক মিয়ানমার নাগরিকের সাম্প্রতিক অনুপ্রবেশ এবং আনুমানিক ৩ লাখ অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিকের দীর্ঘ অবৈধ অবস্থানের কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম এলাকা বিশেষত কক্সবাজার অঞ্চলের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশেষ দূতকে জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী মিয়ানমার নাগরিকদের এবং রাখাইন মুসলমানদের নাগরিকত্ব স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার বিষয়টি যাচাইয়ের জন্য একটি যথাযথ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে বাংলাদেশ। তাছাড়া বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় প্রয়োজন মোতাবেক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার প্রস্তাব করে। মিয়ানমারের বিশেষ দূত প্রস্তাবটি তার দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে তুলে ধরবেন বলে আশ্বস্ত করেন। আলোচনায় নিরাপত্তা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলোচনাধীন দুটি সমঝোতা স্মারক (নিরপত্তা সংলাপ ও সহযোগিতা এবং বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস) দ্রুত স্বাক্ষরের বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়।