বুধবার, ১ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

কোনিও হত্যায় পাঁচ জেএমবি জঙ্গির ফাঁসি

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর

কোনিও হত্যায় পাঁচ জেএমবি জঙ্গির ফাঁসি

জাপানি নাগরিক হোশি কোনিও হত্যা মামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গি দল জেএমবির পাঁচ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে রংপুরের বিশেষ জজ আদালত।

গতকাল ছয় আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা পাঁচজনের উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন আদালতের বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার। সাম্প্রতিককালে জেএমবির হামলায় কয়েকজন নিহত হন। এর মধ্যে কোনিও হত্যা মামলার রায়ই প্রথম। ঢাকায় ইতালির নাগরিক তাভেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিনের মাথায় একই কায়দায় রংপুরে হোশি কোনিও হত্যার ঘটনা ঘটে। এদিকে, রায়কে ঘিরে আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। সকাল সোয়া ৯টায় কারাগারে থাকা পাঁচ আসামিকে আদালতে আনা হয়। সাড়ে ৯টায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করে রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। সোয়া ১১টায় ৬২ পৃষ্ঠার রায় পড়া শেষ হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা, সংঘবদ্ধ হয়ে একই উদ্দেশ্যে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এরা হলেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার পশুয়া টাঙ্গাইলপাড়া এলাকার জেএমবির আঞ্চলিক কমান্ডার মাসুদ রানা ওরফে মন্ত্রী (৩৩), একই এলাকার জেএমবি সদস্য ইছাহাক আলী (৩৪), লিটন মিয়া (৩২), গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার হলদিয়ার চর এলাকার সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুল (৩০) ও কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার মকর রামাল্লী এলাকার আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব (৩১)। এ ছাড়া প্রত্যেক আসামির ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করে আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব পলাতক। তিনি রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এ ছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আটক জেএমবি সদস্য আবু সাঈদকে খালাস দেন বিচারক। তবে আবু সাঈদ কাউনিয়া উপজেলার মধুপুরে মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা এবং রংপুরের বাহাই নেতা রুহুল আমীনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। রায় ঘোষণার পর বিচারক নরেশ চন্দ্র সরকার বলেন, দেশকে অস্থিতিশীল করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি দুর্বল করাই ছিল হোশি কোনিওকে হত্যার মূল উদ্দেশ্য। এমন জঘন্য অপরাধ করায় পাঁচ আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রাপ্য। মামলার অভিযোগপত্রে আরও দুজনের নাম ছিল। তাদের মধ্যে পলাতক জেএমবির সদস্য সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল ৫ জানুয়ারি রাতে ঢাকার মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে এবং নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে হাসান গত বছর ২ আগস্ট ভোরে রাজশাহীতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। দণ্ডপ্রাপ্ত মাসুদ রানা ওরফে মন্ত্রী, ইছাহাক আলী, লিটন মিয়া, সাখাওয়াত হোসেন ওরফে রাহুল কাউনিয়া উপজেলার মধুপুরে মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা এবং রংপুরের বাহাই নেতা রুহুল আমীনকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। আর আহসান উল্লাহ আনসারী ওরফে বিপ্লব বাহাই নেতা হত্যাচেষ্টা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।

কাঠগড়ায় আসামিরা ছিলেন স্বাভাবিক : রায় ঘোষণার সময় কাঠগড়ায় স্বাভাবিক ছিলেন আসামিরা। সবার দৃষ্টি ছিল বিচারকের দিকে। তবে আসামি ইছাহাক আলী কাঠগড়ায় উঠেই গুনগুন করে গান গাইছিলেন। পরে পুলিশের ধমকে গান গাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া : রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা বলেন, ‘প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। এ রায়ের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কেউ ধর্মের নামে মানুষ হত্যার মতো অপরাধ করার সাহস পাবে না।’ আসামিপক্ষের আইনজীবী আবুল হোসেন বলেন, ‘এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে।’

আসামিদের পরিবার যা বলল : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মাসুদ রানা ওরফে মন্ত্রীর স্ত্রী আলেমা বেগম বলেন, ‘অন্যায়ভাবে আমার স্বামীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ন্যায়বিচার পাইনি।’ একই কথা বলেন মাসুদ রানার বড় বোন হনুফা খাতুন। তবে অন্য আসামিদের পরিবারের কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

বিচারের ১৭ মাস : ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সকালে রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়ার বাড়ি থেকে রিকশায় কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে ঘাসের খামারে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন ৬৬ বছর বয়সী হোশি কোনিও। ওই দিনই কাউনিয়া থানার ওসি রেজাউল করিম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের নামে হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউনিয়া থানার ওসি আবদুল কাদের জিলানী গত বছর ৩ জুলাই জেএমবির আট সদস্যের বিরুদ্ধে রংপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। পরে মামলাটি বিশেষ জজ আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ৬০ কার্যদিবসে ৫৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্য দিয়ে ৬ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। দুই সাক্ষী ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় আদালত সাক্ষ্য গ্রহণ শেষের ঘোষণা দেয়। তবে ১৪ ফেব্রুয়ারি আসামি সাখাওয়াতের পক্ষে একজন সাফাই সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ২৮ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন ঠিক করে দেন বিচারক।

হত্যার পরিকল্পনা দুই মাস ধরে : তদন্ত কর্মকর্তার বরাতে আইনজীবী রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা বলেন, রংপুর নগরীর নূরপুরে বাসা ভাড়া নিয়ে আসামিরা দুই মাস ধরে কোনিওকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। আসামিরা ২০১৫ সালের ২ আগস্ট বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাসের পাশাপাশি একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা কেনেন। অটোরিকশায় করে তারা কোনিওর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন। কোনিওকে প্রথম গুলি করেন মাসুদ রানা। পরে মাসুদের সঙ্গী সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল কোনিওর বুকে ও হাতে গুলি করেন। এতে ঘটনাস্থলেই কোনিও মারা যান।

ভালো লোক ছিলেন কোনিও : মুন্সিপাড়ার জাকারিয়া বালার জাপানপ্রবাসী ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে ২০১১ সালে যাতায়াত শুরু করেন কোনিও। ২০১৫ সালের ১৪ মে রংপুরে এসে জাকারিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন কোনিও। সেখান থেকে তিনি কাউনিয়ার সারাই ইউনিয়নের আলুটারি গ্রামে জাপানি কয়েল ঘাসের খামার করছিলেন। আলুটারি গ্রামের মানুষ তাকে ভদ্রলোক বলেই জানত। যার জমি বর্গা নিয়ে ঘাসের খামার করেছিলেন কোনিও সেই জমির মালিক মো. শাহজাহান বলেন, কারও সঙ্গে দেখা হলে হেসে কথা বলতেন কোনিও। ভাঙা বাংলায় সালাম দিতেন, কেউ সালাম দিলে জবাবও দিতেন। উত্তর-পূর্ব জাপানের ইওয়াতে জেলার অধিবাসী কোনিও। সেখানে লেখাপড়া শেষে চলে আসেন তোচিগি শহরে। কোনিও বিয়ে করেননি। তার বাবা-মা জীবিত নেই। ভাই-বোন আছেন কিনা তা জানা যায়নি বলে জানান কোনিওর ভাড়া বাসার মালিক জাকারিয়া বালা।

ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন কোনিও : নিহত হওয়ার আড়াই মাস আগে ১৫ জুলাই ইসলাম গ্রহণ করে গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া নাম নিয়েছিলেন কোনিও। এর পর থেকে তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। ধর্মীয় বই পড়তেন। নিহত হওয়ার পর জাপান দূতাবাসের অনুরোধে ১২ অক্টোবর রাতে মুন্সিপাড়া কবরস্থানেই কোনিওকে দাফন করে স্থানীয় প্রশাসন। ুলাশ দাফনের রেজিস্টারেও গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া নামই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর