শুক্রবার, ৩০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

বদলে যাচ্ছে কারাগার

সাখাওয়াত কাওসার

বদলে যাচ্ছে কারাগার। আতঙ্কের বদলে দেশের প্রতিটি কারাগার হতে যাচ্ছে সংশোধনাগার। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও মানসিক বিকাশে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে বন্দীদের জীবনমান বদলে দেওয়ার প্রত্যয়ে ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ স্লোগানের প্রকৃত বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। মোবাইল ফোনে বন্দীদের কথা বলা, পুনর্বাসনের জন্য প্রশিক্ষণ ও শ্রমের মজুরি প্রদানের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের পাঠানো প্রস্তাবনায় এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে মিলেছে সবুজ সংকেত। অন্যদিকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ওয়েব বেজড প্রিজন ভ্যান, ডাটাবেজ সংযোজনসহ দেশের প্রতিটি কারাগারে লাগছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। সূত্রের দাবি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই ভাগ হওয়ার পর কারাগারের উন্নয়নে গতিশীলতা তৈরি হয়েছে।

কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন বলেন, ‘কারাগারকে আমরা সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তর করার পরিকল্পনা করেছি। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের অনুমতি পেলে আশা করছি আমরা ক্রমান্বয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব।’

জানা গেছে, বন্দীদের কথা বলা এবং কারাগারে ফোনবুথ স্থাপনের জন্য ২০১৩ সাল থেকে একাধিকবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা অধিদফতরের চিঠি আদান-প্রদান এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ইতিবাচক মতামতের পরও ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত দশম সভায় তা বাতিল করা হয়। তবে কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর থেকেই কারাগার আধুনিকায়নের ব্যাপারে তোড়জোড় সৃষ্টি হয়। বন্দীদের কথা বলার অনুমতি-সংক্রান্ত সর্বশেষ আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায় বন্দীদের সঙ্গে তাদের স্বজনদের কথোপকথন হবে এ বিষয়ে কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হচ্ছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।

ওয়েব বেজড প্রিজন ভ্যান : কারাগারে বন্দী পরিবহনে সংযোজিত হয়েছে ওয়েব বেজড প্রিজন ভ্যান। ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যান থেকে বন্দী ছিনতাইয়ের পরই বিষয়টি নিয়ে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ও কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের জঙ্গি, ভয়ঙ্কর অপরাধী এবং ভিআইপি বন্দীদের আনা-নেওয়ার জন্য আপাতত দুটি অত্যাধুনিক প্রিজন ভ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে। এই প্রিজন ভ্যানে অবস্থানরত বন্দীরা কী করছেন, ভ্যানটির অবস্থান কোথায়—কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে এর পুরোটাই সরাসরি দেখতে পাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ।

র‍্যাব-প্রিজন ইনমেট ডাটাবেজ : অপরাধীদের ১০ আঙ্গুলের ছাপ এবং চোখের মণির স্ক্যানিংসহ ২০০ ধরনের তথ্যসংবলিত ডাটাবেজ চালু করেছে র‍্যাব ও কারা কর্তৃপক্ষ। শিগগিরই এটা পাসপোর্ট অধিদফতরের এমআরপি ডাটাবেজের সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এই ডাটাবেজে সংযুক্ত হবে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন বিভাগ। ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি র‍্যাব সদর দফতরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এর উদ্বোধন করেন। আপাতত ইনমেট ডাটাবেজে ৩৫টি কারাগারে প্রায় এক লাখ বন্দীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা বাড়ছে।

বন্দীদের পারিশ্রমিক : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা সূত্র বলছে, ২০১৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ২০১৬ সালে কারা অধিদফতর থেকে জানানো হয়, সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত বন্দীরা জেলকোড অনুসারে বেতের মোড়া, চেয়ার, কাঠের আসবাবপত্র, বেকারি দ্রব্যাদি, ট্রাউজার, ট্র্যাকসুট, টিশার্ট, কার্পেট, পাপশ, পাটের ব্যাগ, নকশি কাঁথা, হস্তশিল্প দ্রব্যাদি উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত থাকেন। উৎপাদিত পণ্যের মূল্যের সঙ্গে ৩৭.৫০% লভ্যাংশ যোগ করে বাজারে বিক্রি করে সরকারি কোষাগারে জমা করা হয়। বর্তমান নিয়মে তাদের কোনো পারিশ্রমিক দেওয়া হয় না। এ কারণে তারা কাজে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন না। এ ছাড়া বিনাশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীরা কোনো উৎপাদনমুখী কাজে অংশ নেন না। উল্টো তারা বিভিন্ন শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত কাজে লিপ্ত হন। এ কারণে পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করলে উৎপাদনের গতি বাড়বে। একই সঙ্গে কারাগারের পরিবেশও ভালো থাকব। ২০১৭ সালের ১১ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ, কারা-১ শাখা থেকে বন্দীদের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে মজুরি দেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেওয়া হয়। এর জবাবে কারা অধিদফতর থেকে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল ইকবাল হাসান স্বাক্ষরিত চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়, কারাশিল্পে বন্দীদের দ্বারা উৎপাদিত পণ্য বর্তমানে ৩৭.৫০% লাভে বিক্রি করা হচ্ছে। এ অর্থের পুরোটাই সরকারি কোষাগারে জমা হচ্ছে। তবে এই লভ্যাংশের অর্ধেক অর্থাৎ ৫০% সাধারণ সেবা ও উৎপাদন বিভাগে সমভাবে বিতরণ করা হলে বন্দীরা উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতার পুরোটা দিতে উৎসাহিত হবেন। লভ্যাংশের টাকা বন্দীর ব্যক্তিগত ক্যাশ হিসেবে জমা থাকবে। বন্দীর ইচ্ছা অনুযায়ী পারিবারিক বা মামলার খরচ হিসেবে তা ব্যয় করা যাবে অথবা তারা তা এককালীন হিসেবে নিতে পারবেন। গুরুত্বপূর্ণ এই প্রস্তাব শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।

উন্মুক্ত জেল : কক্সবাজারের উখিয়া হলদিয়া পালং ইউনিয়নের বড়বিল মৌজায় ৩১০ একর জমিতে উন্মুক্ত কারাগার তৈরির পরিকল্পনা করছে সরকার। এ কারাগারে রাখা হবে স্বল্পমেয়াদি সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের। তারা অর্গানিক ফলমূল, সবজি চাষ, পোলট্রি ফার্ম, মত্স্য চাষ, বৃক্ষরোপণের মতো কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকবেন এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবেন। ২০১৬ সালের ১৬ থেকে ২১ আগস্ট মালয়েশিয়ার গেমাস নামক স্থানে কমিউনিটি রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম (সিআরপি) পরিদর্শন করে এর আদলে বাংলাদেশে কারাগার তৈরির জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে অনুরোধ করেন। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করে সম্ভাব্যতা যাচাই করে চিঠির জবাব দিতে বলে। সর্বশেষ জানা গেছে, ৩২১ একর জমির মধ্যে ৩১০ একর অধিগ্রহণযোগ্য। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সবুজ সংকেত রয়েছে।

কারাবন্দী পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ স্কুল : বন্দীদের পুনর্বাসনের জন্য কাশিমপুর-২ কারাগারে স্থাপিত কারাবন্দী পুনর্বাসন ও প্রশিক্ষণ স্কুলে বন্দীদের রেডিমেড গার্মেন্ট, ডিজিটাল প্রিন্টিং প্রেস, বেকারি, পার্টিকেল বোর্ড, ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস, টেইলারিং, কাঠ ফার্নিচার, পাওয়ার লোম, হস্তশিল্প, প্লাস্টিক ফর্নিচার, পাটজাত দ্রব্য, চামড়াজাত দ্রব্য, ইলেকটিক পণ্য তৈরি নিয়ে মোট ১০টি ট্রেডের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। শিগগিরই এসব প্রশিক্ষণকে কারিগরি বোর্ডেও স্বীকৃতির জন্য আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবে কারা কর্তৃপক্ষ। আইজি প্রিজন বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে কাশিমপুর মহিলা কারাগারকে কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করে এর অবকাঠামোকে প্রশিক্ষণ স্কুল হিসেবে ব্যবহার করে এটিকে ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করা। আর কারিগরি বোর্ডের সনদ দেওয়া হলে তারা কারাগার থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারবেন।’

নিরাপত্তা আধুনিকায়ন : দেশে প্রথমবারের মতো কোনো প্রতিষ্ঠানে বডি স্ক্যানারের সংযোজন ঘটাতে যাচ্ছে কারা অধিদফতর। সঙ্গে থাকছে লাগেজ স্ক্যানার। কারা নিরাপত্তা আধুনিকায়ন প্রকল্পের অধীনে এই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজনের সঙ্গে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মোবাইল জ্যামার বসানোর কথা জানিয়েছেন প্রকল্প প্রধান উপমহাপরিদর্শক এ কে এম ফজলুল হক। তিনি বলেন, দুটি বডি স্ক্যানারের একটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, অন্যটি কাশিমপুর-২ কারাগারে বসানো হবে। ছয়টি লাগেজ স্ক্যানারের মধ্যে ঢাকা, কাশিমপুর-২ ও ৩, হাইসিকিউরিটি, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। জানা গেছে, ৩২ কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের ৩২টি কারাগারে এরই মধ্যে আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর, ওয়াকিটকি, সিসিটিভি এবং টেকওয়ে স্থাপন করা হয়েছে।

ভার্চুয়াল আদালত : দুর্ধর্ষ বন্দীদের নজরদারির জন্য আদালত ও কারাগারকে একই সঙ্গে প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। এ জন্য প্রিজন ভ্যান থেকে সংশ্লিষ্ট বন্দীকে নামানোর পর নির্দিষ্ট কক্ষে নেওয়া হবে। ওই কক্ষ ও আদালত কক্ষ গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করবে কারাগার ও আদালত কর্তৃপক্ষ, যাতে ওই বন্দীরা আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে না পারে।

অবকাঠামো নির্মাণ : শতবর্ষের পুরনো ভবন ভেঙে অবকাঠামোগত সব সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য দেশে ছয়টি কারাগার পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে কারা অধিদফতর। খুলনা, ফেনী, মাদারীপুর, পিরোজপুর, সিলেট ও কিশোরগঞ্জ জেলায় ছয়টি কারাগার পুনর্নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে নতুনভাবে নির্মাণ হওয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আদলে ছয়টি কারাগার পুনর্নির্মাণ করা হবে। বন্দী ধারণক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি কারা অধিদফতরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসন সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর