বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি

কক্সবাজার, চকরিয়া, বান্দরবানে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী

প্রতিদিন ডেস্ক

দেশের কয়েকটি স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কক্সবাজার, চকরিয়া, বান্দরবানে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী আছেন লাখ লাখ মানুষ। চকরিয়া ও পেকুয়ার ৮ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশই পানিবন্দী। মৌলভীবাজারে পানি না কমলেও দুর্ভোগ বেড়েছে। সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানি বেড়ে যাওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

বান্দরবান : বান্দরবান সদরসহ জেলার ৭টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত মঙ্গলবার থেকে লামা, রুমা ও আলীকদমে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা।

মঙ্গলবার রাতের ভারি বর্ষণে ডুবে গেছে লামা বাজারের তিন শতাধিক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানসহ সহস্রাধিক বাড়িঘর, স্কুল-মাদ্রাসা ও অফিস-আদালত। ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় পাহাড়ি ঢলে মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। একইভাবে সাঙ্গু ও বাঁকখালী নদীর পানিও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দী রয়েছেন জেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। লামা ও আলীকদমের স্কুলগুলোতে আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। জেলা পরিষদ ও লামা পৌরসভার সমন্বয়ে এসব আশ্রয় কেন্দ্রে খাবার ও পানীয় জল সরবরাহ করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লামা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়, লামা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, লামা আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লামা ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও দ্বিতল-ত্রিতল দালানে আশ্রয় নিয়েছে উপজেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষ। আলীকদম উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও খোলা হয়েছে বন্যার্তদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র। প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগে খাবার-দাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এদিকে সড়কের অনেক ওপর পানি উঠে যাওয়ায় লামা-আলীকদমের সঙ্গে জেলা সদরসহ সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। পাহাড়ধসের আশঙ্কায় সতর্কতা জারি করেছে বান্দরবান জেলা প্রশাসন। পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চকরিয়া : বানের পানিতে ভাসছে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়ার মানুষ। দুই উপজেলার ৮ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ পানিবন্দী। রান্না করতে না পেরে ১০ হাজার মানুষ দুই দিন ধরে ঠিকমতো খেতে পারছে না। তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের। পানির নিচে তলিয়ে থাকায় অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ প্রায় বন্ধ রয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে অনেকেই খাবার সংগ্রহ করছেন। টানা চার দিনের বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সকালে পানি সামান্য কমলেও দুপুর থেকে ফের বাড়তে থাকে। এ কারণে চকরিয়া পৌরশহর রক্ষাবাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদি ওই শহর রক্ষাবাঁধ ভেঙে যায় তাহলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চকরিয়ার পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়ন এবং পেকুয়ার ৭টির মধ্যে ৪টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। ১টি পৌরসভা ও ২২টি ইউনিয়নের মধ্যে ২০ থেকে ২৫টি গ্রাম ১০-১২ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। গতকাল দুপুরেও কাকারার পূর্বপাড়া ও উত্তরপাড়ার দেড় শতাধিক বাড়ির ভিতর ৩-৫ ফুট উচ্চতায় পানি ছিল। ওই পরিবারের লোকজন বলেন, সকালে একটু পানি কমলেও দুপুর থেকে ফের পানি বাড়তে শুরু করে। তাদের বাড়িতে পানীয় জল ও খাবার সংকট থাকলেও কোনো নেতা বা জনপ্রতিনিধি খোঁজখবর নেওয়ার গরজ করেননি। অনুরূপভাবে অধিক প্লাবিত অপর গ্রামগুলোর বাসিন্দাদের অবস্থাও একই। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধিরা শুকনো এলাকা ও কম পানিতে নামমাত্র খাবার বিতরণ করে সেলফি নিয়ে ফেসবুক রাজনীতি শুরু করলেও টানা দুই দিন অনাহারে থাকা পরিবারগুলোর কাছে কেউই সাহায্য নিয়ে যাননি বা তাদের খোঁজও নেননি কেউ। বন্যাকবলিতরা দাবি তুলেছেন, প্রকৃত বন্যাকবলিত এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে খাবার ও বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দেওয়া হোক। কক্সবাজার : পাঁচ দিনের টানা বৃষ্টিতে এরই মধ্যে জেলার চকরিয়া, রামু, কক্সবাজার সদরসহ আরও কয়েক স্থানে পানির নিচে তলিয়ে গেছে জনপদ। এতে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন। অন্যদিকে  বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তলিয়ে গেছে বীজতলাসহ ফসলি জমি। বন্যার পরিস্থিতি সৃষ্টিতে মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীই মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া সাগরের পানি ঢুকেও অনেক স্থানে বন্যার উপক্রম হয়েছে। বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে পড়ে মহেশখালীতে একজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, টানা বর্ষণের কারণে মাতামুহুরী নদীর পানি উপচে চকরিয়া উপজেলার পৌসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড এবং সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, কোনখালী, ঢেমুশিয়া, খুটাখালী, ডুলাহাজারা, সাহারবিল পুরোসহ ১৭ ইউনিয়নে প্রায় অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বাঁকখালী নদীর পানি উপচে পড়ে রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারখোপ, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়ি, রাজারকুল ও ফতেখাঁরকুলে ইউনিয়নের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। মইশকুম নামক স্থানে সড়ক পানিতে ডুবে থাকায় রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়ক যোগাযোগ পুরো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও, চৌফলদণ্ডী, খুরুস্কুল, ঝিলংজা, জালালাবাদ, পোকখালী, পিএমখালীসহ অনেক স্থান পানিতে ডুবে গেছে। এত প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পেকুয়া উপজেলার সদর ইউনিয়ন, রাজাখালী, মগনামাসহ সবকটি ইউনিয়নের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব স্থানের অনেক মানুষ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আশ্রয় কেন্দ্র ও ইউপি ভবনসহ বিভিন্ন উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে চকরিয়ায় বন্যা দেখা দিয়েছে। নদীর বাঁধ উপচে প্রবাহিত হচ্ছে ঢলের পানি। কক্সবাজার সদরে ঢল ও জোয়ারের পানিতে ঈদগাঁওসহ সদরের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী মানবেতর জীবনযাপন করছেন হাজার হাজার মানুষ। ঈদগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিম ভোমরিয়াঘোনা, দরগাহ পাড়াসহ ৬-৭টি গ্রাম; ইসলামাবাদের খোদাইবাড়ী, ওয়াহেদরপাড়া, হিন্দুপাড়ারসহ ৫টি গ্রাম; জালালাবাদের লরাবাক এলাকায় বেড়িবাঁধ ভাঙনে মোহনবিলাসহ ৮-৯ গ্রাম, পোকখালী, ইসলামপুর এবং চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম জোয়ারের পানি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া পিএমখালী, ঝিংলংজারসহ অনেক গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। সিলেট : সিলেটের ৮ উপজেলায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বন্যার্তদের জন্য কিছুটা জোরদার করা হয়েছে ত্রাণ তৎপরতা। গতকাল নতুন করে চাল ও নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় মেডিকেল টিমও কাজ শুরু করেছে। বন্যার্ত মানুষের সহায়তায় যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সিলেটিরা সাহায্যের হাত বাড়াতে কাজও শুরু করেছেন। মৌলভীবাজার : গত দুই দিন ধরে ধীরগতিতে পানি কমতে শুরু হলেও হাকালুকি হাওরের পানিবন্দী হাজার হাজার মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে । রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ। বন্ধ রয়েছে কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল বিশ্ববিদ্যালয় মহিলা কলেজসহ  প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক  বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান। পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না পেয়ে কষ্টের মধ্যে রয়েছেন দুর্গত মানুষ।

বগুড়া : কয়েক দিনের অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে বগুড়া সারিয়াকান্দির কাছে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে উপজেলার চরাঞ্চলসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এতে নিম্নাঞ্চলের পাট ও রোপা আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের রৌহাদহ, চন্দনবাইশা ইউনিয়নের শেখপাড়া, চরঘুঘুমারি, কুতুবপুর ইউনিয়নের নিচ কর্ণিবাড়ি, ধলিরকান্দি ও বয়রাকান্দি গ্রামে নতুন করে বন্যার পানি ঢুকেছে। এতে প্রায় এক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়েছে। বরিশাল : বরিশালে গতকালও মাঝারি আকারের বৃষ্টি হয়েছে। টানা বৃষ্টিতে বিভিন্ন সড়কে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে দুর্ভোগে পড়েছে নগরবাসী। জলাবদ্ধতার কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী। বরিশাল আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবদুুল হালিম জানান, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। নদীবন্দরে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর