বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
জলাবদ্ধতার নতুন খড়গ

সাড়ে তিনশ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম মহানগরে সড়ক আছে ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার। কিন্তু এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতবিক্ষত। অধিকাংশ সড়ক দিয়েই যান চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অনেক সড়কে হয়েছে বড় বড় গর্ত। এসব গর্তে জমে আছে পানি। টানা বর্ষণ, পানি জমে থাকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে সড়কগুলোর এখন বেহাল অবস্থা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এসব সড়ক মেরামত করার কথা। কিন্তু তবুও বেহাল অবস্থা সড়কের। তবে গত সোমবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে চসিক মেয়র ‘সাম্প্রতিক বর্ষণে চট্টগ্রাম শহরের ২৫-৩০ শতাংশ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা’ বলে দাবি করেছেন।

এদিকে গতকাল সারাদিন চট্টগ্রামে ভারি বর্ষণ না হলেও থেমে থেকে বৃষ্টি হয়। তবে কোনো কোনো নিম্নাঞ্চল থেকে পানি গতকালও নামেনি। ফলে এসব এলাকায় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি গতকালও ছিল বলে জানা যায়। চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরে মোট ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার সড়ক আছে। গতবছর বর্ষা এবং অন্যান্য কারণে ৪৭৬ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার সড়কের ক্ষতি হয়। এর আগে ২০১৪ সালে বর্ষায় ক্ষতি হয়েছিল ১০০ কিলোমিটার সড়ক। বর্তমানে নগরীতে অ্যাসফল্ট (পিচঢালা) ৬২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৭ দশমিক ২০ মিটার প্রস্থর সড়ক আছে ১ হাজার ১৪০টি। ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ দশমিক ৫৫ মিটার প্রস্থের কংক্রিট সড়ক আছে ১ হাজার ১০৯টি। ৫৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ দশমিক ৫০ মিটার প্রস্থের ব্রিকসলিং সড়ক আছে ২৩৫টি। ৪৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার প্রস্থের কাঁচা সড়ক আছে ২৪৫টি। চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে মোট ১ হাজার ১০০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্ষা শেষ হলে এক মাসের মধ্যে পুরোটায় সংস্কার করা সম্ভব। তাছাড়া বর্তমানে রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে সংস্কার কাজ চলছে।’ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আরাকান সড়কের সংস্কার প্রসঙ্গে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘ওয়াসার কাটিংয়ের জন্য সড়কটির অবস্থা খারাপ হয়েছে। তবে সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এটিকে আমরা দ্রুত সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ সড়কের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। এক্ষত্রে আমরা আমাদের পাঁচটি ডিভিশনের সবগুলো টিমকেই এখানে কাজে লাগাচ্ছি। এখন থেকে প্রত্যেকটি সড়কেই এ পদ্ধতিতে কাজ করব। কারণ পৃথক পৃথকভাবে করলে কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগে।’

চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মনিরুল হুদা বলেন, রোদ থাকলে শহরের ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো এক মাসের মধ্যেই সংস্কার করা সম্ভব। আরাকান রোড তো কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে। এই সড়ক দিয়ে পাইপ লাইন নেওয়ার জন্য ওয়াসার কাটিং বেশি ঝামেলা করেছে। তিনি বলেন, তবুও সাগরিকায় আমাদের নিজস্ব অ্যাসপল্ট প্লান্টে তৈরিকৃত মিক্সার (ইট, বালি, সিমেন্ট ও বিটুমিনের মিশ্রণ) দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ সংস্কার করা হচ্ছে। যা যা চসিকের নিজস্ব শ্রমিকরা কাজ করছেন। এক্ষেত্রে দৈনিক ১০ ট্রাক (১০ হাজার স্কয়ার ফুট) মিক্সার ব্যবহার করা হচ্ছে। সড়ক সংস্কারে ব্যবহূত মিক্সার তৈরির উপকরণ তথা ইট, বালি, সিমেন্ট ও বিটুমিনের জন্য সদ্য বিদায়ী অর্থ বছরে (২০১৬-২০১৭) অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ১২০ কোটি টাকা। চসিক সূত্রে জানা যায়, গত মাস থেকে নগরীর ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের সংস্কার কাজ শুরু করে। চসিকের ৫টি বিভাগ পৃথকভাবে সংস্কার কাজ করছে। তবে এতে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না। পরে সবগুলো টিম একসঙ্গে একই সড়কে সংস্কার কাজ শুরু করে। আরকান সড়ক থেকেই নতুন পদ্ধতির এ সংস্কার কাজ শুরু করে। সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, প্রয়োজনীয় সংস্কারের অভাবে ইতিপূর্বে সড়কের বিটুমিন ও ইট-কংক্রিট উঠে যায়। সৃষ্ট গর্তগুলোর আকৃতিও দিন দিন বড় হচ্ছে। তার ওপর বিভিন্ন জায়গায় ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি সড়কের বেহাল দশাকে আরও বেশি শোচনীয় করেছে। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি। প্রায় তিন কিলোমিটার আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের প্রায় পুরোটাই খানাখন্দে ভরে উঠেছে। সড়কটির বিভিন্ন অংশ ইট-কংক্রিট উঠে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের। সেখানে আবার পানি জমে রূপ নিয়েছে ক্ষুদ্রাকৃতির পুকুরে। একই অবস্থা বন্দর-নিমতলা সড়কেরও। আগ্রাবাদ ব্যাপারিপাড়া সড়কেও ছোট ছোট গর্ত দেখা গেছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একে খান গেট পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশের অবস্থাও করুণ। আড়াকান সড়কের বহদ্দারহাট থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত অংশটির অবস্থা বেশি করুণ। বহদ্দারহাট মোড় থেকে বাস টার্মিনাল, পুরাতন চান্দগাঁও, সিএন্ডবি মোড়ের সড়কটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সড়কটিতে কয়েকশ ছোট বড় গর্ত দেখা গেছে। সড়কটির এই বেহাল দশার জন্য দায়ী ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ি। নির্মাণাধীন মুরাদপুর-লালখানবাজার ফ্লাইওভারের দুই পাশের সড়কজুড়েও ছোট বড় অসংখ্য গর্ত। কাপাসগোলা খলিপট্টি মোড় থেকে জঙ্গিশাহ মাজার পর্যন্ত, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন শাহ আমানত সংযোগ সড়ক, দুই নম্বর গেট থেকে অক্সিজেন মোড়ের বিভিন্ন অংশের অবস্থাও করুণ। বিশেষ করে দুই নম্বর গেট থেকে বায়েজিদের টেকনিকেল কলেজ পর্যন্ত পুরোটাই খানাখন্দে ভরা। প্রধান প্রধান সড়কের বাইরে নগরীর অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের স্থানীয় বাসিন্দা মীর শাফায়াত বলেন, পানিতে সড়কটি ডুবে থাকে। এটি আজকের সমস্যা নয়। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার নেই। অথচ প্রতি নির্বাচনেই প্রতিনিধিরা এসব ইস্যুকে সামনে রেখে ভোট প্রত্যাশা করেন। তবে ভোটের সবই মিছে হয়ে যায়।’ অন্যদিকে, পরিবহন মালিকদের দাবি, সড়কের নাজুক অবস্থার কারণে গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ায় তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক দিয়ে যানবাহন চলা মুশকিল হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিনই নতুন যন্ত্র লাগাতে হচ্ছে। মেরামত করতে হচ্ছে যানবাহনের ইঞ্জিন, চেসিস, এঙ্গেলসহ নানা যন্ত্রাংশ। তাই মালিকদের প্রতিদিনই গুনতে হচ্ছে নগদ টাকা। পড়ছে অতিরিক্ত জ্বালানি।’

পাহাড়ধসে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ : রাঙামাটি প্রতিনিধি জানান, সম্প্রতি রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ করেছে জেলা প্রশাসন। এর তথ্যানুযায়ী, রাঙামাটির ১০টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ১২ হাজার ৫৫৮টি। তার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ির সংখ্যা ১ হাজার ২৩১টি। আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৯ হাজার ৫৩৭টি। তথ্যানুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—বন, বিদ্যুৎ, শিল্প কারখানা, মত্স্য খামার, গবাদি পশু, হাঁস মুরগি। এ ছাড়া ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলি জমি, যার পরিমাণ ১৮ হাজার ৯৯.৩১ হেক্টর। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, পর্যটন এবং বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানার স্থাপনা ও সম্পদ ক্ষতির হিসাব বিবরণী এ তালিকায় নেই। রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান জানান, ক্ষয়ক্ষতির এ হিসাব চূড়ান্ত নয়। যদিও প্রাথমিকভাবে নিরূপণ করা খসড়া ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে বিস্তারিত তথ্য আরও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। চূড়ান্ত হিসাবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে-কমতে পারে। চূড়ান্ত তালিকা আবার সরকারের কাছে পাঠানো হবে।

পাহাড়ধসের আশঙ্কা : বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় রাঙামাটি ফের পাহাড়ধসের আশঙ্কা বাড়ছে। আতঙ্কে এলাকা ছাড়ছেন মানুষ। ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে নিরাপদে সরে যেতে সতর্কবার্তা জারি রেখেছে জেলা প্রশাসন।

জাতীয় কমিটির রাঙামাটি পরিদর্শন : গতকাল সকালে নৌপথে পাহাড়ধসে রাঙামাটির ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গঠিত ভূমিধস সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির সদস্যরা। কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. অর্ধেন্দু শেখর রায় জানান, ১৩ জুন পাহাড়ধসের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায় ‘ভূমিধসের কারণ চিহ্নিতকরণ ও ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রণালয়টির অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা।

সর্বশেষ খবর