বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা

হামলার আভাস পাওয়া যায় পঁচাত্তরের বিভিন্ন সময়

জুলকার নাইন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর হামলা হতে পারে, এমন আভাস ১৯৭৫ সালের বিভিন্ন সময় পাওয়া যেতে থাকে। ভারতের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে সতর্ক করার কথা বলা হয়। এমনকি ’৭৫-এর ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে সরিয়ে নিতে ভারতীয় হেলিকপ্টার পাঠানোর কথাও লিখেছেন তখন ঢাকায় কর্মরত ভারতীয় সাংবাদিক মহেন্দ্র বেদ। কিন্তু এসব সতর্কবার্তাকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্য পাঠানোও হয়নি শীর্ষ পর্যায়ে। ফলে রক্ষা করা যায়নি বাংলাদেশের জাতির জনককে। সেই সময়কার বিভিন্ন  স্মৃতিকথা, সাক্ষাৎকার ও ইতিহাসের বইয়ে এমন বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে। এসব নিয়ে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাদির জুনায়েদের মতে, বৃহৎ এক ষড়যন্ত্রের জন্য এবং দায়িত্ব পালনে অনেকের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। খ্যাতনামা সাংবাদিক ও ’৭৫-এ বাংলাদেশে ইউএনআই বার্তা সংস্থার ব্যুরো চিফ মহেন্দ্র বেদের মতে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের আগের দিন ১৪ আগস্ট ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিতে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেটি সীমান্তে বিধ্বস্ত হয়। তিনি লিখেছেন, ১৪ আগস্ট। হাতে তেমন কাজ নেই। আমি পরিকল্পনা করলাম স্ত্রীকে নিয়ে শাহবাগ এভিনিউয়ে রিকশায় ঘুরে বেড়াব। আমরা উভয়ে ‘নামকিন’ পছন্দ করতাম, পাশের একটি দোকান থেকে সেগুলো কেনারও পরিকল্পনা করলাম। আমার স্ত্রী তৈরি হচ্ছিল। এর মধ্যেই আমি ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের (আইএফআই) একটি হেলিকপ্টার বাংলাদেশি সীমানায় বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেলাম। এটি বাংলাদেশের অনুমতি নিয়ে সম্ভবত আগরতলা থেকে কলকাতায় যাচ্ছিল। পরের খবর, পরিষ্কার ধারণা সত্ত্বেও অফিশিয়ালি এটিকে অস্বীকার করা হলো এ ইঙ্গিত করে যে, এটি ছিল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে ‘উদ্ধারের’ মিশন। ভারতীয় সরকার সম্ভবত হুমকিতে পড়তে যাচ্ছিল। আমি কখনই নিশ্চিত হতে পারলাম না এ বিষয়ে এবং সারা দিনই চলল অনিশ্চিত কিছু গুজব। তবে এটি নিশ্চিত ছিল যে, এটি ছিল একটি গোয়েন্দা-ব্যর্থতা শুধু বাংলাদেশির জন্য নয়, ভারত ও অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশ যারা স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছিল তাদের জন্যও। ‘রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা’ শীর্ষক বইয়ের ১২৮-২৯ পৃষ্ঠায় আনোয়ার উল আলম লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসের এক রাতে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরী রক্ষীবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে এসে জানান যে, সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুর ওপর হামলা হতে পারে এমন সংবাদ তিনি পেয়েছেন। সেই রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি এবং শেখ মণির বাড়ির ওপর সতর্ক নজর রাখা হয়। এর মাস দেড়েক পর একদিন রক্ষীবাহিনীর পরিচালক ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান প্রাপ্ত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করেন যে, রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা হতে পারে। আবারও রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা রাতে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।

সেই সময় রাষ্ট্রপতির স্পেশাল অফিসার ছিলেন মাহবুব তালুকদার। তিনি তার বই ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’-এর পৃষ্ঠা ১৪২-১৪৪-এ লিখেছেন, ‘১৯৭৫-এর আগস্টের অল্প সময় আগে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত তার পরিচিত এক ব্যক্তি উদ্বেগের সাথে তাকে জানান যে, বঙ্গবন্ধুকে সরানোর গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই খারাপ কিছু একটা ঘটবে।’ তিনি মাহবুব তালুকদারকে অনুরোধ করেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুকে দ্রুত এই কথা জানানোর জন্য। সেই কর্মকর্তা অবশ্য তার এই দাবির পক্ষে তত্ক্ষণাৎ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুকে না জানালেও, মাহবুব তালুকদার তার বন্ধু শেখ মণিকে এই কথা জানান। কিন্তু শেখ মণি গোয়েন্দা সংস্থার সেই কর্মকর্তার দেওয়া তথ্যকে আজগুবি খবর বলে উড়িয়ে দেন।

সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলিও এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সরকারকে কোনো আগাম তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৫ সালে ডিজিএফআইর মহাপরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুর রউফ। তিনি ছিলেন পাকিস্তান-প্রত্যাগত অফিসার। ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট— বেঙ্গল ল্যান্সারস্ আর মেজর খন্দকার আবদুর রশীদের নেতৃত্বাধীন টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের সৈনিকদের। এ দুটি ইউনিটই ঢাকার ৪৬ ব্রিগেডের অধীনে ছিল। তখন এই ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। তিনি তার বই ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’-এর পৃষ্ঠা ১১৯-এ লিখেছেন, আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মাস দুয়েক আগেই অজ্ঞাত কারণে ৪৬ ব্রিগেডের একমাত্র গোয়েন্দা ইউনিটটিকে প্রত্যাহার করে সেনা হেডকোয়ার্টারের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ফলে ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডারের তার নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট থেকে কোনো তথ্যপ্রাপ্তির সুযোগ ছিল না। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় ফারুক-রশীদের অন্যতম সহযোগী তৎকালীন মেজর বজলুল হুদা সেনাসদরে সামরিক গোয়েন্দা পরিদফতরে কর্মরত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর