রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

নাফ নদে রোহিঙ্গার ঢল মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

আতঙ্কে মিয়ানমার রক্ষীদের গুলি

নিজস্ব প্রতিবেদক

নাফ নদে রোহিঙ্গার ঢল মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

দলে দলে বাংলাদেশের দিকে আশ্রয়প্রার্থী হয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নতুন করে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় তারা নাফ নদ পার হয়ে কক্সবাজারে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। গতকালও পুশব্যাক করা হয়েছে শতাধিক রোহিঙ্গাকে। এসবের মধ্যেই গতকাল বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ক্যাম্প থেকে গুলি বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মিয়ানমার বাহিনীর দাবি, জিরো পয়েন্টে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প আক্রমণকারী ভেবে আতঙ্কে ফাঁকা গুলি করেছে বিজিপি। ঢাকায় মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে এসব বিষয়ে তলব করে ব্যাখ্যা চেয়েছে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাতে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরুর পর শুক্রবার ভোর থেকে শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ পালিয়ে বাংলাদেশের দিকে আসতে থাকে। পালিয়ে আসা নারী-পুরুষদের অনেকেই সীমান্ত এলাকায় বসে আছে। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে অসহায় জীবন-যাপন করছে তারা। গতকালও কক্সবাজারের পালংখালী এলাকার সীমান্তে অবস্থান করতে দেখা গেছে অনেককে। তারা চেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের। মূলত টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের উলুবনিয়া, লম্বাবিল, খারাইংগ্যা ঘোনা, উখিয়ার পালংখালী এলাকা দিয়ে নাফ নদ অতিক্রম করে সীমান্তের উপকূলীয় বিভিন্ন কেওড়া বনে লুকিয়ে থাকছে রোহিঙ্গারা। পরে রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প, নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্প, উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প, কুতুপালং ও বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সুযোগ বুঝে আশ্রয় নিচ্ছে তারা। সহিংসতার মধ্যে থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা নারী দাবি করেছেন, সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গ্রামগুলোতে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে গুলি ও বোমা বর্ষণ শুরু হয়। এরপর কিছু সময় বিরতি ছিল। পরে রাত ৩টা থেকে আবারও গোলাগুলি শুরু হয়। রাতের আঁধারে কালো আর মিলিটারির পোশাক পরা ব্যক্তিরা গুলি চালিয়েছে বলে দাবি তার। সীমান্তে অবস্থান করা ব্যক্তিদের একজনের বক্তব্য, হামলাকারীরা গুলি করছিল। নারীদের অত্যাচারও করছিল। এ ছাড়া পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করছিল। এ ভয়ে সব রোহিঙ্গা পুরুষ পালিয়ে যায়। ফলে শিশু আর বৃদ্ধদের নিয়ে বিপদে পড়ে নারীরা। ছিল না খাবারের সংস্থান। পানির মধ্যে বহু গুলি খাওয়া লাশ ভাসতে দেখেছেন বলেও দাবি করেছেন তিনি। এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আহত মো. মুছা নামে এক রোহিঙ্গা নাগরিক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। একই সময় মো. ইদ্রিস নামে এক শিশু এবং মোক্তার হোসেন ও মো. শামসুলসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। শনিবার সকালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চারজন হাসপাতালে ভর্তি হয়। বেলা সোয়া ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মুছার। নিহত মো. মুছা রাখাইনের মংডু এলাকার মো. ইসমাইলের ছেলে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ কন্ট্রোল রুমের উপ-পরিদর্শক মো. জহির বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হামলায় তারা আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তারা শুক্রবার রাতে কক্সবাজার সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর হামলাকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মীদের সংঘর্ষে মোট ৭১ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ১২ জন নিরাপত্তাকর্মী ও ৫৯ জন আক্রমণকারী। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চির দফতর থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নিহত আক্রমণকারীদের ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

টেকনাফের মিয়ানমার জেটি ঘাটে কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লে. কমান্ডার জাফর ইমাম সজীব সাংবাদিকদের বলেন, ‘শনিবার ভোররাত ৪টার দিকে আমিসহ কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন কমান্ডার কবিরের নেতৃত্বে পৃথক টিম নাফ নদে টহলকালে সাবরাং নয়াপাড়া সীমান্ত দিয়ে ৫৬ জন রোহিঙ্গাবোঝাই একটি ট্রলার অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের আটক করি। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলারটি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এতে ২১ জন নারী, ২১ জন শিশু ও ১৪ জন পুরুষ ছিল। এ সময় কিছুটা দূরে আরও আট থেকে ১০টি রোহিঙ্গাবোঝাই ট্রলার দেখা গেলেও কোস্টগার্ডের বাধার মুখে সেগুলো মিয়ানমারে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।’ তিনি জানান, মিয়ানমারে ঘটনার পর থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কায় নাফ নদে কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছে জনবল। সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নদীতে কোস্টগার্ডের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাইন উদ্দীন খান জানান, একই দিন ভোররাতে টেকনাফ হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির আইসি উপ-পরিদর্শক (এসআই) মাহির খানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে বিভিন্ন গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে অনুপ্রবেশকারী ১৭ মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করে। এদের মধ্যে পাঁচ নারী, পাঁচ শিশু ও সাতজন পুরুষ। আটক রোহিঙ্গারা রাতের আঁধারে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে লোকালয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিল। পরে আটক ১৭ মিয়ানমার রোহিঙ্গা নাগরিককে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিজিবির মাধ্যমে হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি জানান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। তবে লোকালয়ে যাতে কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেদিকে পুলিশ সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। এ ছাড়া কমিউনিটি পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ এলাকায় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে অস্থায়ী চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালানো হবে বলে জানান তিনি।

মাছ ধরা বন্ধে মাইকিং : সেন্টমার্টিন দ্বীপে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর বরাত দিয়ে মাইকিং করে সাগরে মাছ ধরা ট্রলার নিয়ে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এ সময় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে বলে মাইকে প্রচারণা চালানো হয়। এ তথ্য নিশ্চিত করে সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহমদ জানান, শুক্রবার রাতে সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে মিয়ানমারের মেরুল্লা ও হাইসসুরাতা এলাকায় আগুনের লেলিহান শিখা দেখা গেছে। বঙ্গোপসাগরে দেখা গেছে মিয়ানমার নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ। এ কারণে কোনো মাছ ধরা নৌকাকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেন্টমার্টিনের দক্ষিণ ও পূর্বে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।

বান্দরবান সীমান্তে মিয়ানমারের গুলি : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি তুমব্রু সীমান্ত লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করেছে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিপি। গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে তুমব্রু ২ নম্বর পিলারের কাছে ৮ থেকে ১০ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে তারা। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। পরে বিজিপি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে। ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান জানান, মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপি সীমান্তে গুলি বর্ষণ করেছে। এ ঘটনার পর বিজিবি তাত্ক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। [প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম, টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি ও বান্দরবান প্রতিনিধি]

সর্বশেষ খবর