রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা ভোটার নিয়ে উদ্বিগ্ন ইসি

২০ টাকায় চেয়ারম্যান সনদ ভাড়া করা হচ্ছে মা-বাবা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও চট্টগ্রাম

রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন জনপ্রতিনিধিরা। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নির্বাচন কমিশনও। কক্সবাজার সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে উৎকণ্ঠা চলছে। এরই মধ্যে গতকাল ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা অন্তর্ভুক্তি ঠেকাতে চট্টগ্রামে ‘বিশেষ সভা’ করেছে ইসি। ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে চট্টগ্রাম বিভাগের ৩০ উপজেলাকে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসের সভায় একজন নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, বিজিবির আঞ্চলিক অধিনায়ক, কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডারসহ ৩০টি ‘বিশেষ এলাকার’ শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। সভায় অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জনপ্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা ভোটার করে ভোটব্যাংক বাড়াতে চান। অনেক প্রতিষ্ঠিত রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীও আছেন। তাদের কারও কারও স্পন্সরশিপে অনেক রোহিঙ্গা এখানে ভোটার হতে বিভিন্নভাবে তৎপর। এ ছাড়া অনেক রোহিঙ্গার পাসপোর্টও আছে। চেয়ারম্যান সনদ আছে। ২০-৫০ বা ১০০ টাকায় এখন কক্সবাজারে চেয়ারম্যান সনদ পাওয়া যায়। অনেকেই ভোটার হতে মা-বাবাও ভাড়া করছে। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গা ভোটার হওয়াটা মহামারী আকার ধারণ করেছে। ভোটার হয়ে তারা জাতীয় পরিচয়পত্র পাচ্ছে এবং সরকারি সব সুযোগ সুবিধার দাবিদার হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রজন্ম বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত হয়ে গেছে। ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, রোহিঙ্গা ভোটার হওয়া ঠেকাতে উদ্যোগ নিয়েছে ইসি। তাই ৩০ উপজেলাকে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশেষ এলাকার মধ্যে কক্সবাজারের সব উপজেলা, রাঙামাটির ১০ উপজেলার মধ্যে ৮টি, বান্দরবানের সাত উপজেলার সবকটি, চট্টগ্রামের ১৬ উপজেলার ৭টিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির যাচাই-বাছাই ছাড়া ৩০টি উপজেলায় কেউ ভোটার হতে পারবে না। চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার শংকর রঞ্জন সাহার সভাপতিত্বে সভায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাইদুল ইসলাম, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান, নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) সালেহ মো. তানভীর উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মঈনউদ্দীন খানসহ প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।  

ভোটার হতে মা-বাবা ভাড়া করছে রোহিঙ্গারা : গতকাল ইসির বিশেষ সভায় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রশাসনিক ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের বক্তব্যে বেশ কিছু তথ্য উঠে আসে। আলোচনায় উঠে আসে কক্সবাজার জেলার বেশ কিছু এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের ‘চাপের’ বিষয়টিও। ভোটার হতে তিন নিকটাত্মীয়ের এনআইডির তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে নাম ও ছবি বদল, এনআইডি কার্ড ভাড়ায় আনা, এমনকি আত্মীয়-স্বজন সাজিয়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার চেষ্টার তথ্যও দেন মাঠ কর্মকর্তারা। সভায় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বলেন, রাউজান, ফটিকছড়ি, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া নগরীর বায়েজিদ এলাকায়ও কিছু রোহিঙ্গার বসবাস রয়েছে। এসব এলাকাকে বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে তালিকাভুক্তির অনুরোধ জানান তিনি। সভায় গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, গ্রামে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ক্ষমতা অনেক বেশি।  তারা যাদের ভোটার করতে বলবে, তাদের ভোটার করতে হয়। বিদেশ থেকে টাকা-পয়সা উপার্জন করে রোহিঙ্গারা চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কিনে ভোটার হয়। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পরিবার থেকে মা-বাবা ভাড়া করে আনছে।  বাংলাদেশিরা এসে সন্তান পরিচয় দিয়ে ভোটার করার জন্য চাপ দেয়। একজন কর্মকর্তা বলেন, ওমরাহ ভিসায় অনেকে সৌদি আরব গিয়ে সেখানে রোহিঙ্গা হিসেবেই ছিল। দেশে ফিরে আবার ভোটার হতে চাইছে। চকরিয়া উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তা মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কক্সবাজারে ভাসমান, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা আর অন্য জেলার বাসিন্দারা আছেন। সঙ্গে যোগ হয়েছে যারা সৌদি ফেরত। তারা বলছে তাদের পাসপোর্ট আছে। চেয়ারম্যান সনদ আছে। কক্সবাজার সদরের নির্বাচনী কর্মকর্তা বলেন, সরকারি খাসজমিতে অসংখ্য অবৈধ বসতি স্থাপনাকারী আছে। সেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকায় বিদ্যুৎ বিলও তারা দিতে পারে। কক্সবাজার জেলা নির্বাচনী অফিসার বলেন, যারা ভোটার হয়নি তাদের ভোটার করতে জনপ্রতিনিধিরা মরিয়া। ৫৭ হাজার ৪০২টি ফরম পূরণ হয়েছে। রেজিস্ট্রার্ড আছে আরও ২৫ হাজার নাম। এরা সবাই ভোটার হতে চায়। আপনারা চাপ দিচ্ছেন আবার তারাও চাপ দিচ্ছে। যে কাগজ দিতে হয় সবই কিনতে পাওয়া যায়। বিশেষ কমিটির সদস্যদের যদি যাচাইয়ের পর স্বাক্ষরের বা আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে তাহলে হয়তো কিছু করা সম্ভব।

সর্বশেষ খবর