বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

সীমান্ত এলাকায় লাখো রোহিঙ্গা দেশে ঢোকাতে সক্রিয় দালালরা

ফারুক তাহের, ঘুমধুম (নাইক্ষংছড়ি) থেকে

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাহাড়ি খাদে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অধিবাসী অবস্থান নিয়েছে। এসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারের ফকিরা বাজার, কামুনছি, টাওয়া, ল্যামশি, ওয়ালিদং, আলচাপরে, মেমেতাই, মেমেচোং, ল্যামরি, বনপাড়া, মিরিঞ্জাপাড়া, কোয়াচ্ছং, আচাম্বো, লেনুবাছা, সাকতাকইন্যা পাড়ার অধিবাসী। গত বৃহস্পতিবার থেকে তারা বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করছে।

এদের অনেকে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দালালদের হাত ধরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। সীমান্তের যে পয়েন্টগুলোয় বিজিবির জোরদার টহল নেই, সেসব এলাকা বেছে নিয়েছে শক্তিশালী দালাল চক্র। বান্দরবানের আমতলী, ফকিরা বাজার, পুরানমাইজ্যা ও উখিয়ার বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালীসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে রাতের আঁধারে অনেকটা অবাধে অনুপ্রবেশ করার কথা রোহিঙ্গা শরণার্থীরাই তথ্য দিয়েছেন। গতকাল প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

এদিকে গতকালও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার ভিতর দফায় দফায় গুলি ও হেলিকপ্টারের মহড়া দিয়েছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। এতে রোহিঙ্গাদের আতঙ্কের মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া সংলগ্ন পলিথিনের তাঁবু টানিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে থাকা হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর এখন প্রতিমুহূর্ত কাটছে আতঙ্ক আর উদ্বেগের মধ্যে। এ ছাড়া তাদের ফেলে আসা বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের টেকনাফ, নাইক্ষংছড়ির জলপাইতলী ও তমব্রু সীমান্ত থেকে দেখা গেছে আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডুলি।

গতকাল বিকাল চারটার দিকে মিয়ানমারের আকাশ সীমান্তে একাধিক হেলিকপ্টারকে টহল দিতে দেখা যায়। এ সময় তিনদফা গুলির শব্দ শোনার পর রোহিঙ্গাদের চারটি পাড়ায় আগুন দেখা  গেছে। বিকাল পাঁচটায় আবারও গোলাগুলির শব্দ কানে আসে এবং আরও একটি পাড়া থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি দেখা যায়। এরপর তমব্রু সীমান্তের কাছাকাছি একটি পাড়া আগুনে জ্বালিয়ে দেয় মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বিজিপি। গতকাল বেলা দুইটার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি নেমে আসায় খোলা আকাশের নিচে সীমান্তের জিরো পয়েন্টে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে। এ সময় ছোট শিশুদের কান্না ও অসুস্থ হয়ে পড়া বয়োবৃদ্ধদের আহাজারি এপার-ওপারের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। গতকাল বেলা ১১টার দিকে জলপাইতলী ও তমব্রু সীমান্ত পরিদর্শনে আসেন বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। নিজের মাটি কামড়ে ধরে নিজেদের অধিকার ধরে রাখার কথাও বলেন তারা। এ সময় বিজিবি ২৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুর হাসান খানসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সরেজমিন দেখা যায়, মঙ্গলবার ভোর সাতটা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত দলে দলে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কুতুপালং অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্পের দিকে ছুটছে। এ সময় তাদের মাথায় কাপড়-চোপড়ের পুঁটলি ও টুকটাক গৃহস্থালি মালপত্র দেখা যায়। ক্যাম্পের কাছাকাছি আসতেই তাদের অনেককে আত্মীয়স্বজন ও পুরনো শরণার্থীরা বিভিন্ন শিবিরে নিয়ে যান। এদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি।

সক্রিয় দালালচক্র, তালিকায় চার এসআই : রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে একটি দালালচক্র সক্রিয় রয়েছে। একেকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কুতুপালংয়ের অননুমোদিত শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিতে এক থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে থাকে দালালরা। গত ২৪ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দালালচক্রের যে ৩৩ জনের তালিকা তৈরি করেছে তাতে পুলিশের চারজন এসআইও (উপপরিদর্শক) আছে বলে উখিয়া থানা সূত্রে জানা গেছে। এর বাইরে অধিকাংশই বান্দরবন ও পুনর্বাসিত রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং টেক্সিচালক। তালিকাভুক্ত পুলিশের চার এসআই হলেন, এরশাদুল হক, মো. আলমগীর, মো. আমিনুল ও মোহাম্মদ শাহীন। এরা প্রত্যেকেই বর্তমানে ঘুমধুম পুলিশ তদন্ত ক্যাম্পে কর্মরত। গত সোমবার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কুতুপালংয়ের বিভিন্ন শিবিরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে সাত জন দালাল ও টেক্সিচালককে আটক করেছে উখিয়া থানা পুলিশ। তাদের প্রত্যেককে সাড়ে ছয় হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। অপর দুজন মিয়ানমারের পুরনো শরণার্থী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে উখিয়া থানার ওসি  জানিয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের খণ্ডচিত্র : আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের খণ্ডচিত্র দেখা যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতে আসা কিছু ভিডিওর চিত্রে। একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে শতাধিক নারী ও শিশু গহিন অরণ্যে অবস্থান নিয়েছে। ভিডিও চিত্রে কয়েকটি তাঁবুতে কয়েকজন অবস্থান করতে দেখা গেলেও খোলা আকাশের নিচে অসংখ্য নারী ও শিশু মানবেতর জীবন যাপন করতে দেখা গেছে। ওই ভিডিও চিত্রে কথা বলেন বয়স্ক এক নারী। তিনি বলেন, ‘বার্মার সেনাবাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে। শিশু, নারী এবং পুরুষদের গুলি করে হত্যা করছে। প্রাণ বাঁচাতে আমরা জঙ্গলে পালিয়ে এসেছি। এখানেই অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছি।’ একটি কওমী মাদ্রাসা ও গ্রামে অগ্নিসংযোগের ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর তাণ্ডব চিত্র। ভিডিওচিত্র ধারণকারী এ সময় দাবি করেন, তারা কখনো মুজাহিদ সদস্যদের দেখেনি। কিন্তু মুজাহিদদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রাম ও মসজিদে অগ্নিসংযোগ করেছে সেনাবাহিনী। এ সময় এক নারী ও পুরুষ হরকাতুল আল ইয়াকিনের সামরিক কমান্ডার আবু আম্মার জুনুনী ওরফে আতাউল্লাহর সাহায্য কামনা করতে দেখা যায়। একই সঙ্গে বিদেশী মুজাহিদদের সাহায্য কামনা করেন একজন পুরুষ। একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় লোকজন সংঘবদ্ধ ভাবে হামলা করছে রোহিঙ্গাদের ওপর। আরেকটা ভিডিও চিত্রে এক শিশু ও দুই নারীর মরদেহ দেখানো হয়। পাশেই তাদের জন্য একটি কবর তৈরি করছিল তিন ব্যক্তি। যিনি ভিডিও করছিলেন, তার দাবি এ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছে সেনাবাহিনী। ভিডিও চিত্রগুলোতে সেনা অভিযানে নিহত ব্যক্তিদের দেখা যায়। মরদেহগুলোর বেশির ভাগই ছিল নারী ও শিশুর। ১৭ মিনিট ২২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও একটি সংগঠনের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ। ওই ভিডিও চিত্রে এক সেনা কর্মকর্তাকে নির্বিচারে গুলি করার নির্দেশ দিতে দেখা যায়।

সর্বশেষ খবর