বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
কলকাতার চিঠি

রাম-রহিম সিংয়ের পর কে হবেন ডেরার প্রধান

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মহাত্মা গান্ধী, জওহর লাল নেহরু থেকে ড. মনমোহন সিং যতদিন ভারতে রাজত্ব করেছেন, তারা সবাই ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করে রেখেছিলেন। কিন্তু গভীর অনুতাপ ও পরিতাপের বিষয়, গত সাড়ে তিন বছরে নরেন্দ্র মোদির রাজত্বে ধর্মকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বারবার দেখা গেছে কখনো গো-মাংস, কখনো হিন্দু-মুসলমানকে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বারবার উসকে দিয়েছে। আর সঙ্ঘ পরিবার এবং সাধু-সন্ন্যাসীরা গোটা দেশে উলঙ্গ নৃত্য করে চলেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার লেনসন ম্যান্ডেলা, ইরাকের প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধান সাদ্দাম হোসেন, বাংলাদেশের জন্মদাতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতারা ধর্ম ও রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। দুর্ভাগ্য ভারতবর্ষের সাড়ে তিন বছর আগে ক্ষমতায় এসে সাধু-সন্ন্যাসী, স্বঘোষিত বাবারা ধর্মের নামে গুন্ডাগিরি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে চলেছে। সরকার বারবার এদের নিরাপত্তা দিয়েছে। সোমবার হরিয়ানার স্বঘোষিত বাবা গুরমিত রাম রহিম সিংকে ধর্ষণের মামলায় ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে বিশেষ সিবিআই আদালত। গত তিন দশকে কয়েকশ কোটির টাকার মালিক হয়েছিলেন তিনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী এবং আরও শীর্ষ বিজেপি নেতারা এই ধর্ষক-বাবাকে মাথায় তুলেছিলেন।

তবে এই রায়ে খুশি হয়নি সিবিআই। তারা ধর্ষক বাবার সাজার মেয়াদ আরও বাড়ানোর আবেদন করেছে। আইনজীবী মহলে জোর আলোচনা চলছিল গুরমিত রাম রহিম বাবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডই হতে চলেছে। বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন যে সহ-ধারায় চার্জ গঠন করা হয়েছিল তাতে গত শুক্রবার ধর্ষণ-মামলায় দোষী বলে সাব্যস্ত হয়েছে বাবাজি। সেই চার্জ অনুযায়ী ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। রোহতকের সুনারিয়া জেলটাকে প্রথমে দুর্গে পরিণত করে ফেলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। এরপর দুর্গের নিরাপত্তায় ঘিরে ফেলা হয় গোটা জেল চত্বরকে। জেল এবং সংলগ্ন এলাকাটি ঘিরে রেখেছেন ২৩০০ সশস্ত্র সেনা। আরও কয়েক কোম্পানি সেনাকে রাখা হয়েছে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে। জেল তথা আদালত চত্বরে যাতে একটি মাছিও গলতে না পারে, সে ব্যাপারে কড়া নজর রেখেছেন জওয়ানরা। সেই জেলেরই একটি কক্ষকে তৈরি করা হয়েছে মেকশিপ্ট এজলাস হিসেবে। হরিয়ানা সরকারের বিশেষ নিরাপত্তায় বিচারপতি জগদীপ সিংকে উড়িয়ে আনা হয়েছে হেলিকপ্টারে চাপিয়ে। সুনারিয়া জেল সংলগ্ন হেলিপ্যাড থেকেই বিচারপতির নিরাপত্তায় মোতায়েন রয়েছে সেনাবাহিনীর বিশেষ টিম। তারাই বিচারপতিকে সুরক্ষা-বলয় তৈরি করে নিয়ে যান কার্যত দুর্গে পরিণত হওয়া জেলের এজলাসে। অশান্তির আশঙ্কায় চূড়ান্ত পর্যায়ের নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে রোহতকসহ গোটা হরিয়ানা। নিরাপত্তার বলয় চড়ানো হয়েছে পাঞ্জাব, রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশও। স্বাধীন ভারতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে এ পর্যায়ের যুদ্ধ-আয়োজন এই প্রথম বলেই মনে করা হচ্ছে। তাও তা করা হয়েছে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর উন্মত্ত আচরণ ঠেকাতে। এ পর্যায়ের প্রস্তুত সাধারণত নেওয়া হয়ে থাকে সীমান্তের কোনো বিদেশি শক্তির মোকাবিলা করতে, আর নয়তো কোনো জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে অপারেশনের সময়। রোহতকের এক প্রান্তে সুনারিয়া জেলকে বানিয়ে ফেলা হয়েছে একটি দুর্গে। এখানেই রয়েছেন বাবাজি। জেল চত্বর ঘিরে থিকথিক করছে আধা-সামরিক বাহিনী, সেনাবাহিনী এবং রাজ্য পুলিশের বিশেষ টিম। আদালত চত্বর তো বটেই, জায়গায় জায়গায় করা হয়েছে শক্ত ব্যারিকেড, যা ভেঙে এগোনো কার্যত দুষ্কর। আজ সকাল থেকেই রোহতকসহ গোটা হরিয়ানায় ২৮ কোম্পানি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আরও চার কোম্পানি সেনাকে আনা হচ্ছে বিশেষ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে। সেনাবাহিনী তাদের পজিশন নিয়ে নিয়েছে। ছয়টি স্তরে ছড়ানো হয়েছে নিরাপত্তার জাল। সকালেই গ্রেফতার করা হয়েছে ডেরার দুই শীর্ষ নেতাকে। আদালতের কঠোর অবস্থানের কারণে প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে অন্তত বাহ্যিকভাবে হলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন। তিনি বলেছেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছে প্রশাসনকে পর্যুদস্ত হতে দেওয়া হবে না। প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে বার্তা পাওয়ার পরেই নিরাপত্তা বলয় আঁটোসাঁটো ও নিশ্ছিদ্র করে দেওয়া হয়। হরিয়ানা ও পাঞ্জাব তো বটেই, উত্তর প্রদেশ এবং দিল্লির একটা অংশেও স্কুল-কলেজ, অফিস, দোকানপাট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বাস-ট্রেনসহ সব রকমের পরিবহনকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মোবাইল পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টুজি, থ্রিজি, ফোরজি সিডিএমএ এবং জিপিআরএস মোবাইলের পরিষেবা এবং ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ, যাতে কোনো রকম গুজব ছড়াতে না পারে। কোনো রকম ঝুঁকি না নিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ডঙ্গল-চালিত ইন্টারনেট এবং এসএমএস সার্ভিসও। আগামীকাল বেলা দেড়টা পর্যন্ত এই পরিষেবাগুলো বন্ধ থাকবে। এছাড়াও জেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় কাঁটাতার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের তরফে সাধারণ মানুষের কাছে বাড়ির বাইরে না বেরনোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গুরমিত রাম-রহিম সিংয়ের পর কে হবেন ডেরার প্রধান? এই প্রশ্ন শুধু ডেরা সাচ্চাভক্তদেরই নয়, আমজনতার মনেও ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে বাবার উত্তরসূরি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন তারই ছায়াসঙ্গী তথা পালিতা-কন্যা হানিপ্রীত ইনসান। নিজেকে বাবার যোগ্য মেয়ে বলেই মনে করেন হানিপ্রীত। পাঁচকুল্লা থেকে রাম রহিমকে হেলিকপ্টারে রোহতকের জেলে নিয়ে যাওয়ার সময়ও বাবার সঙ্গে ছিলেন এই হানিপ্রীত। সে সময় প্রশ্ন উঠেছিল, কঠোর নিরাপত্তা সত্ত্বেও ধর্ষক-বাবার সঙ্গে কী করে হেলিকপ্টারে উঠলেন হানিপ্রীত? পরে অবশ্য পুলিশ জানিয়েছিল, আদালতের নির্দেশেই হানিপ্রীত রাম রহিমের সঙ্গে হেলিকপ্টারে উঠেছিলেন। জন্মসূত্রে প্রিয়াঙ্কা তানেজা ১৯৯৯ সালে সাচা সৌদা ভক্ত বিশ্বাস গুপ্তাকে বিয়ে করে হানিপ্রীত ইনসান নাম গ্রহণ করেন। কিন্তু বিয়ের কিছু দিন পরেই তিনি অভিযোগ করেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজন পণের জন্য তার ওপর অত্যাচার করছে। এরপর ২০০৯ সালে তাকে দত্তক নেন রাম রহিম। ২০১১ সালে হানিপ্রীতকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তার স্বামী। ডেরা সাচা সৌদায় গুরমিতের পরেই অন্যতম দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তি হলেন এই হানিপ্রীত। রাম-রহিমকে দোষী সাব্যস্ত করার পর যখন বেশিরভাগ ডেরা কর্তা পালিয়ে গিয়েছিলেন, সে সময়ও দেখা গিয়েছে হানিপ্রীতকে। নিজের ওয়েবসাইটে নিজের অভিনেত্রী, পরিচালক এবং সম্পাদক হিসেবে বর্ণনা করেছেন এই হানিপ্রীত। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ফলে ডেরার সূত্রেই মনে করা হচ্ছে সাচা সৌদার পরবর্তী কর্ত্রী হতে চলেছেন হানিপ্রীতই।

♦ বিশেষ আয়োজন পূষ্টা - ৫ রকমারি এ

সর্বশেষ খবর