শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা

চট্টগ্রাম ফেনী মানিকগঞ্জ যশোরে আটক

বিশেষ প্রতিনিধি

ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা

নাইক্ষ্যংছড়িতে রোহিঙ্গাদের অবস্থান। গতকাল তোলা ছবি —রোহেত রাজীব

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনী, যশোর, মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা সদস্যকে আটক করেছে। তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে। ধারণা করা হচ্ছে, নিবন্ধন কার্যক্রম জোরালো না হলে এবং রোহিঙ্গাদের আলাদাভাবে নিয়ন্ত্রিত এলাকায় রাখা না গেলে তারা মিশে যেতে পারে দেশের মূল জনস্রোতের সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে কক্সবাজারের স্থানীয় দালাল চক্র। একশ্রেণির দালাল তাদের নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন কর্মব্যস্ত শহরে শ্রমজীবী মানুষের ভিড়ে রোহিঙ্গাদের মিশিয়ে দেওয়ার তৎপরতা চালাচ্ছে। এতে সারা দেশ নতুন করে নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তা ছাড়া রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বাইরে ছড়িয়ে পড়লে তাদের নিয়ে সারা দেশে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্টেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন প্রশাসন কাজ শুরু করেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যাতে আশ্রয়শিবির ছেড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য সেখানে কড়া নজরদারির পাশাপাশি চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নগরের কালুর ঘাট ও শাহ আমানত সেতুতে চেকপোস্টের মাধ্যমে নজরদারি শুরু হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকাসহ অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর প্রবেশমুখেও একাধিক তল্লাশি চৌকি বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে সে ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে সতর্ক করা হয়েছে। এদিকে রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ এবং তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে গিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এবার কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দিলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বিবেচনায় রয়েছে। সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবাধে চলাফেরা করছে। এখন নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারাও মিশে যাচ্ছে সারা দেশে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের ভাষা, পোশাক, চলাফেরা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিল থাকায় তাদের মিশতে মোটেও সমস্যা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পুরনো শরণার্থীরাও তাদের সহায়তা করছে। এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করার সময় চার রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বিজিবি। বুধবার রাতে তাদের আটক করা হয়। তারা হলেন মিয়ানমারের মংড়ুর আনোয়ার (৪০), জাফর (৪৫), আজমল (৩৮) ও কালু মিয়া। বুধবার ভোরে বেনাপোল সীমান্ত থেকে বিজিবি সদস্যরা দুই পরিবারের আট রোহিঙ্গা সদস্যকে আটক করে। তাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। বেনাপোল পোর্ট থানা পুলিশ এসব রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিরাপদ হেফাজতে পাঠাতে যশোর আদালতে হাজির করে। যশোরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক বুলবুল ইসলাম আট রোহিঙ্গা শরণার্থীকে যশোর জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম থেকে বুধবার রাতে তিন রোহিঙ্গা পরিবারের ২০ জনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ১১ শিশু, ছয় নারী ও তিনজন পুরুষ রয়েছেন। তাদের সিংগাইর পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. যুবায়ের জানান, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো রোহিঙ্গাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

চট্টগ্রাম থেকে রেজা মুজাম্মেল জানান, রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যে নগরের কয়েকটি স্থান ও ১৪ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে। তবে সরকারি সিদ্ধান্তমতে, চিকিৎসা শেষে এবং নানাভাবে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের আটক করে টেকনাফে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে কোনো বাড়িতে আশ্রয় নিতে না পারে সেজন্য চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার ১৬ থানায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরের প্রবেশপথগুলোয়ও সতর্ক নজরদারি রাখতে বলা হয়েছে। মহানগর পুলিশসূত্র জানায়, ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর থেকে বুধবার রাতে ২৬ জনকে টেকনাফে পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া হাটহাজারী উপজেলার ফটিকা ইউনিয়ন থেকে ১৯, সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের ঘোড়ামারা থেকে ১৮, পতেঙ্গা থেকে ১৪, চান্দগাঁও থেকে ১১ ও বাকলিয়া থেকে ৫ জনকে টেকনাফে পাঠানো হয়েছে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) রেজাউল মাসুদ বলেন, ‘রোহিঙ্গারা থাকবে কেবল কক্সবাজারে। চট্টগ্রামের কোনো বাড়িতে তাদের পাওয়া গেলে আটক করে টেকনাফ পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

জানা যায়, আগে থেকেই চট্টগ্রাম নগর ও বিভিন্ন উপজেলায় রোহিঙ্গাদের বসবাস ছিল। ভিক্ষার পাশাপাশি তারা মজুরের কাজ করত। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আগে থেকে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দাদের। ইতিমধ্যে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী বিভিন্ন বাসে তল্লাশি চালিয়ে আটক রোহিঙ্গাদের টেকনাফে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ২৫ আগস্ট থেকে কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্ত দিয়ে পাহাড়ি পথে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজলোয় অবস্থান নিয়েছে। এর মধ্যে রাউজান, বোয়ালখালী, রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, পটিয়া, বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য রোহিঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নিজ দেশের সেনাবাহিনীর অত্যাচার আর বর্বরতার মুখে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর নজরদারি চলছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেউ যাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে এজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতা রয়েছে।’ নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রাখার জন্য বাংলাদেশে যে ক্যাম্প তৈরি হয়েছে সেখানে যদি পর্যাপ্ত ত্রাণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করা যায় তাহলে তারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে না। কিন্তু সরকার যদি সেই ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা বেঁচে থাকার তাগিদে ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র কাজ খোঁজার চেষ্টা করবে। বর্তমানে শরণার্থীরা যে এলাকায় অবস্থান করছে সেখানে কাজের চেয়ে তাদের সংখ্যা বেশি।’

জেনারেল রশীদ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক স্থানে কৃষিশ্রমিকের অভাব আছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মাধ্যমে সেই অভাব পূরণ করা সম্ভব। তবে আশঙ্কার বিষয় এই যে, তারা অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। অন্যদিকে তারা যেসব এলাকায় কাজ খুঁজছে সেখানে মজুরির হার কমে যেতে পারে। স্থানীয় শ্রমিকরা এ বিষয়টি ভালোভাবে নাও নিতে পারে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে কিছুটা সামাজিক ঝুঁকি তৈরির আশঙ্কা থাকলেও তাদের দ্বারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে এটি এখনো আমাদের অনুমান। ঝুঁকি কমাতে তাদের নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এগুলো নিশ্চিত না করে তাদের জোর করে ক্যাম্পে আটকে রাখা যাবে না।’

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেশন মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন ড. তাসনিম সিদ্দিকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমানে ক্যাম্পে যে রোহিঙ্গারা আছে তাদের মন থেকে আমাদের ভয় দূর করতে হবে। এখানে যে তারা নিরাপদে আছে তাদের মনে সেই আস্থা তৈরি করতে হবে। নিজেদের প্রাণভয়ে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যেতে পারে কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের আস্থা তৈরি করতে হবে। তাদের জন্য সবরকম সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আরেকটি বিষয়ে তাদের বোঝাতে হবে, যত দিন পর্যন্ত মিয়ানমারের পরিস্থিতি ভালো না হচ্ছে তত দিন পর্যন্ত আমরা তাদের এ দেশে রাখব, তাদের সেখানে ঠেলে দেব না। তবে কিছু নিরাপত্তা বিশ্লেষক রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে “নিরাপত্তা হুমকি” তৈরি হতে পারে এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসেন। অথচ ঘটনা হচ্ছে উল্টো, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তাই ঝুঁকির মধ্যে আছে।’ ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য ২ হাজার একর জমি দিয়েছে। জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলসহ অন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও তাদের জন্য তহবিল জোগাড় করছে। ১৬ কোটি জনসংখ্যার দেশে ৪ লাখ রোহিঙ্গা মিশে গেলে শ্রমবাজারের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।’ উল্টো এই রোহিঙ্গাদের দিয়ে কম মজুরিতে কাজ করানো হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা নারীদের যৌন নির্যাতনের ও শিশুদের মজুরি বৈষম্যসহ অন্যান্য নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে তাসনিম সিদ্দিকী মনে করেন।

৪ রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার : টেকনাফের নাফ নদ থেকে ৪টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সকালে নাফ নদের সাবরাং ঝিনাপাড়া ও শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট থেকে এসব মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া পয়েন্টে মা ও শিশু এবং টেকনাফে সাবরাং ঝিনাপাড়া পয়েন্টে একজন পুরুষ ও এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল বেলা ১১ টায় শাহপরীর দ্বীপ মোহনায় আরও একটি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে।

এতে ৩ জন জীবিত উদ্ধার হলেও নিখোঁজ রয়েছে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী ও শিশু। 

কোস্টগার্ড শাহপরীর দ্বীপ স্টেশন ইনচার্জ মোস্তফা কামাল বলেন, নৌকাডুবির সংবাদ তিনি শুনেছেন। এ পর্যন্ত ৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. মাইন উদ্দিন খান জানান, গতকাল সকালে সাবরাং নাফ নদ ও শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পয়েন্ট থেকে ৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা উদ্ধার হওয়া মৃতদেহগুলো মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের। তাই যথাযথ প্রক্রিয়ায় এসব মৃতদেহ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর