শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

জটিল সময় পার করছে বাংলাদেশ

অবরোধ আরোপে ইইউ পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণ, মিয়ানমার বলল ১৭৬ গ্রাম মানুষশূন্য, অতীত স্মরণ করালেন ট্রুডো, সোচ্চার বিশ্ব

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

জটিল সময় পার করছে বাংলাদেশ

তীব্র পানি সংকট। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বড়ছনখোলায় গতকাল এক রোহিঙ্গা শিশুকে গর্তে জমা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করতে দেখা যায় — রোহেত রাজীব

এক জটিল সময় পার করছে বাংলাদেশ। হঠাৎ করে নেমেছে শরণার্থীর ঢল। গত ২০ দিনে চার লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। আগের প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হওয়া নতুন এই ঢল সৃষ্টি করেছে সংকট। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্ব সম্প্রদায়ও উদ্বিগ্ন-উৎকণ্ঠিত। কিন্তু সংকট সৃষ্টিকারী মিয়ানমার এখনো রোহিঙ্গা শূন্য করার মিশন অব্যাহত রেখেছে। খোদ মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র ১৭৬ গ্রাম মানুষ শূন্য বলে জানিয়েছে। তারপরও থামেনি নির্যাতন। সীমান্তের ওপারে এখনো আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশকে আরও কতদিন এই  বিশাল ভার বইতে হবে সেটাও অনিশ্চিত। যে জাতিসংঘকে পাশে নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ তারাও বলছে, পরিস্থিতি জটিল। মিয়ানমারের রাখাইনে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বছরের শেষ নাগাদ নতুন ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসতে পারে। এদিকে ইইউ পার্লামেন্টে গতকাল মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।

জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সহকারী হাইকমিশনার জর্জ ওকথ ওবো জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এমনিতেই অনেক সমস্যা আছে। এর মধ্যে গত ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর চার লাখ  রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এদের আশ্রয় দেওয়া সত্যি প্রশংসার। কিন্তু এই শরণার্থীর ঢল বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। ফলে এক জটিল সময় পার করছে বাংলাদেশ। একটি মানবাধিকার সংস্থা হিসেবে সরকারকে সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। গতকাল ঢাকায় বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের  চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকের সঙ্গে ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ শেষে সহকারী হাইকমিশনার জর্জ ওকথ ওবো বলেন, ‘এসব সমস্যা নিয়ে কথা বলতে হবে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের বিষয়ে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করছি। আশা করি, বাংলাদেশে আমাদের কার্যক্রমকে অন্যান্য দাতা সংস্থাও সমর্থন করবে।’ বার্তা সংস্থা সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের মুখপাত্র জো হতে বলেছেন, রাখাইনের ৪৭১ গ্রামের মধ্যে রোহিঙ্গাদের থাকা ১৭৬টি গ্রাম এখন মানুষ শূন্য। ৩৪ গ্রাম আংশিক শূন্য। প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র অবশ্য ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও ব্যবহার করেননি। তাদের ‘বাঙালি’ বলে অভিহিত করেছেন। মুখপাত্র আরও বলেছেন, যারা পালিয়ে গেছে, তাদের সবাইকে ফিরতে দেওয়া হবে না। তাদের যাচাই-বাছাই করা হবে। যাচাই-বাছাই শেষে তাদের দেশে ফিরতে দেওয়া হবে।

জানা যায়,  মিয়ানমার যাই বলুক এবার রোহিঙ্গা নিয়ে পুরো বিশ্ব এক ধরনের ঐকমত্যে এসেছে। গত ৯ বছরে প্রথমবারের মতো নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। চীন ও ভারতের কিছুটা ভিন্ন অবস্থান থাকলেও ভারত ইতিমধ্যে ত্রাণ পাঠিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য। চীনও প্রস্তুতি নিচ্ছে ত্রাণ পাঠানোর। অন্যদিকে, মালয়েশীয় প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক গতকাল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রোহিঙ্গাদের বিপন্নতা বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। নাজিবের দাবি অনুযায়ী, তার কাছে রাখাইনের পরিস্থিতি জেনেই ট্রাম্প মিয়ানমারের ব্যাপারে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ত্রাণ পাঠানোর প্রক্রিয়া নির্ধারণে ট্রাম্প তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন বলেও জানান নাজিব। আলোচনার পর রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে যৌথ বিবৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও মালয়েশিয়া। নাজিব বলেন, মালয়েশিয়া রোহিঙ্গাদের হয়ে কথা বলেই যাবে। এরপর ওআইসি ও জাতিসংঘের মধ্য সংগঠনগুলোর কাছে আহ্বান জানাবে তারা। তিনি বলেন, ‘যা হচ্ছে সেটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় হস্তক্ষেপ করতে চাই না।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছে, ইইউ আইনপ্রণেতারা এ সংক্রান্ত একটি গৃহীত প্রস্তাবে অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের হত্যা, হয়রানি, ধর্ষণ ও তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে মিয়ানমারের প্রতি। ইইউর আইনপ্রণেতারা আক্রান্ত এলাকায় এবং পলায়নরত জনগোষ্ঠীর কাছে ত্রাণ সংস্থাগুলোর যেতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে মিয়ানমার সরকার ও দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চির প্রতি সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় ঘৃণা উসকে দেওয়ার ঘটনাগুলোর স্পষ্ট নিন্দা জানাতে বলেছেন ইইউ নেতারা। এ ছাড়া সামাজিক বৈষম্য ও বৈরিতা মোকাবিলার আহ্বান জানানো হয়েছে। আইনপ্রণেতারা উল্লেখ করেছেন, ১৯৯০ সালে সু চি ইইউ পার্লামেন্ট থেকে দেওয়া যে শাখারফ পুরস্কার পেয়েছেন, সেটা দেওয়া হয়ে থাকে মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুদের রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য। অন্যদিকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বুধবার মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকে ফোন করে অতীত ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পাশে থাকা কানাডা সু চিকে সম্মানসূচক যে নাগরিকত্ব দিয়েছিল সেটাই এখন প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে কানাডায়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ফোন করেন ট্রুডো। কানাডার প্রধানমন্ত্রীর অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ট্রুডো বার বার নৈতিক ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে একজন স্টেট কাউন্সিলরের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। একই সঙ্গে বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বেসামরিক নেতাদের এখন জরুরি ভিত্তিতে রাখাইনে চলমান সহিংসতা বন্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া দরকার। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আক্রান্ত অঞ্চলগুলোতে নির্বিঘ্ন প্রবেশের বিষয়গুলোও তাদেরই নিশ্চিত করতে হবে বলে ফোনকলে বলেন ট্রুডো।

জানা যায়, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ‘অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট’ এক বছরের তদন্ত শেষে গত ২৪ আগস্ট চূড়ান্ত প্রতিবেদন অং সান সু চির কাছে জমা দেয়। ৬৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই ২৪ আগস্ট দিবাগত রাতে ত্রিশটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে রহস্যজনক হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় নিহত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য। তারপরই হামলার জন্য রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের দায়ী করে জবাব হিসেবে সেনাবাহিনী পুরো অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। কমপক্ষে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় আর প্রাণভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি দেয় বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার উদ্দেশেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ড শুরু করে।

মিয়ানমারের ওপর অবরোধে ইইউ পার্লামেন্টে প্রস্তাব : মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপের সুপারিশসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানানোর এক দিন পর গতকাল এ প্রস্তাব গৃহীত হলো। রোহিঙ্গা বিষয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে এক বিতর্কের পর ইইউ এবং ইউরোপীয় কমিশনকে মিয়ানমার সরকারের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন ঠেকানোর জন্য গৃহীত যৌথ প্রস্তাবে চাপ বৃদ্ধির আহ্বান জানানো হয়। যৌথ প্রস্তাবে শাখারভ পুরস্কারপ্রাপ্ত অং সান সু চিকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, এই পুরস্কার তাকেই দেওয়া হয়, যে মানবাধিকার রক্ষা করবে, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেবে এবং আন্তর্জাতিক আইনকে সম্মান জানাবে। এ ছাড়া দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়, যারা এগুলো পালন করবে না তাদের শাখারভ পুরস্কার ফেরত দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে কিনা তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। প্রস্তাবে বলা হয়, ইইউ সদস্যরা ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের জন্য প্রস্তুত। এতে মিয়ানমার যেসব বাণিজ্যসুবিধা পেয়ে থাকে সেটি পুনর্বিবেচনা করার বিষয়েও বলা হয়।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৫০ জনের বেশি সদস্য এই যৌথ প্রস্তাব সংসদে নিয়ে আসেন এবং বিতর্কের পর এটি গৃহীত হয়। পাশাপাশি রাখাইনে হত্যা, সহিংস ঘটনা, বেসামরিক নাগরিকদের সম্পদ ধ্বংস এবং বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ ছাড়া পার্লামেন্ট হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণ বন্ধের জন্য মিয়ানমারের সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি জোরালো আহ্বান জানায়।

এ ছাড়া মিয়ানমার সরকার ও বিশেষ করে স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চিকে আহ্বান জানানো হয় সব ধরনের জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতাকে নিন্দার জন্য। বাংলাদেশ সীমান্তে ভূমিমাইন সরিয়ে ফেলার জন্য তারা মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে প্রস্তাবে দুঃখ প্রকাশ করে বলা হয়, ২০১৫ সালের ১৮ মে অং সান সু চির রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র বলেছিলেন, মিয়ানমার সরকারের উচিত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া। এ ছাড়া সহিংসতা বন্ধে ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে চীন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, ‘আসিয়ান ও আঞ্চলিক সরকারসমূহ যেন মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করে এবং সব বেসামরিক মানুষকে সুরক্ষা ও শরণার্থীদের সহায়তা দেয়।’

সর্বশেষ খবর