শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

জীবন শুরু হচ্ছে শরণার্থী হিসেবে

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) থেকে

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বড় ছনখোলা নোম্যান্স ল্যান্ডে এখনো অবস্থান করছে ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু-কিশোর। ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নোম্যান্স ল্যান্ড ঘেঁষা একটি ঝিরির কর্দমাক্ত পানিতেই গোসল করছে কয়েকজন শিশু। তাদের মায়েরাও ওই অল্প পানিতে হাঁড়ি-পাতিল ধোয়ার পাশাপাশি বাচ্চাদের গোসল করাচ্ছিলেন। ওই ঝিরিরই এখন তাদের পানির প্রধান উৎস। নোংরা পানিতে গোসল করার দৃশ্য দেখে পাশেই এক মেডিকেল টিমের কর্মকর্তা বললেন, ‘বাচ্চাগুলোর যে কোনো মুহূর্তে ডায়রিয়া হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া চর্মরোগ ও নিউমোনিয়ার শঙ্কাও রয়েছে।’ এ দৃশ্য শুধু বড় ছনখোলাই নয়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করা কিংবা নোম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান নেওয়া প্রতিটি শরণার্থী ক্যাম্পের চিত্র প্রায় একই। বোতলজাত খাওয়ার পানি কিছুটা জোটলেও গোসল-শৌচকার্য কিংবা ধোয়ামোছার পানির চরম সংকট রয়েছে। অবশ্য কিছু কিছু স্থানে নলকূপ বসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে শরণার্থী সে াতে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা হবে অন্তত সাত লাখ। যার মধ্যে অর্ধেকই শিশু-কিশোর। এখন তারাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এ নিয়ে সম্প্রতি জাতিসংঘও শঙ্কা প্রকাশ করেছে। জীবনের শুরুতেই ‘শরণার্থী শিশু’ কিংবা ‘রোহিঙ্গা শিশু’ হিসেবে আখ্যা পেয়েছে তারা। পৃথিবীর স্বাভাবিক আলো-বাতাসে যাদের বেড়ে ওঠার কথা ছিল, তারা এখন সবচেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এসব শিশুর ভবিষ্যৎ এখন ঘোর অন্ধকারে। আদৌ  কোনো দিন শিক্ষার আলো পাবে কিনা তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। জীবন বাঁচানোর যুদ্ধে শামিল এসব শিশু চরম ক্ষুধার্ত। প্রতিদিনই তারা ক্যাম্পের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে ত্রাণের অপেক্ষায়। স্থায়ীভাবে তাদের কোনো ঠিকানা হবে কিনা তাও অনিশ্চিত।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১১ সেপ্টেম্বর বড় ছনখোলার এই ক্যাম্পে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে শিশু সুরুজ্জামান। একইভাবে ওই ক্যাম্পে মারা যায় আরও একজন। সে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিল। আরও কয়েকজন ওই রোগে আক্রান্ত হয়ে মেডিকেল ক্যাম্পে চিকিৎসা নিচ্ছে। কুতুপালং শিলের ছড়া, লাম্বাশিয়া, মধুরছড়া, বালুখালী, থাইংখালী, বাঘঘুনা, পালংখালী ঢালা পাহাড়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির আচারতলী, চাকঢালা, ঘুমধুম ইউনিয়নের পশ্চিমকুল, টিভি রিলে কেন্দ্র, টেকনাফের লেদা, মুছনীসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পেও শিশু-কিশোররা পানিবাহিত এসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বেসরকারি এক মেডিকেল ক্যাম্প সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ৫০ জনেরও বেশি শিশু মারা গেছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর ছনখোলা ক্যাম্পে জাফর আলীর স্ত্রী খুরশিদা বেগম জন্ম দেন এক মৃত সন্তান। এমন মায়ের সংখ্যাও হবে অন্তত ১০ জন। দীর্ঘ পথ হেঁটে আসার পাশাপাশি অর্ধাহারে-অনাহারে থাকায় শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েন তারা। গতকাল নাইক্ষ্যংছড়ির বড় ছনখোলা ক্যাম্পের কাছাকাছি গিয়ে দেখা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। পাশেই একটি ঝিরে অল্প পানিতে গোসল করছে কয়েক শিশু। ময়লা ও কর্দমাক্ত পানিতে মগ, বালতি ও পাতিল দেখা যায় তাদের হাতে। কেউ কেউ ওই ময়লা পানিই পান করছে। পাশেই কয়েকজন মহিলাকে হাঁড়ি-পাতিল মাজতেও দেখা গেছে। দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় এই ক্যাম্পে ত্রাণ খুবই কম যাচ্ছে বলে শরণার্থী রোহিঙ্গারা জানিয়েছে। এলাকার সাধারণ মানুষ রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায়। তবে এটা অপ্রতুল বলে রোহিঙ্গারা জানিয়েছে। খাদ্যসামগ্রী, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধেরও চরম সংকটের কথা বলেন তারা। এরই মধ্যে সেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নেয় কয়েকজন শিশু। এরা হলো মোহাম্মদ হানিফ ও মাজুমা বেগমের কন্যা জেসমিন বিবি, মো. একরাম ও কুলসুম খাতুনের নবজাতক ওবায়দুল হক, আলী হোসেন ও নবিনসোনা দম্পতির আরও এক শিশুর জন্ম হয়। কিন্তু তারা কোনো সুচিকিৎসা পাননি। এর মধ্যে মা ও শিশুরা শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছেন বলে জানান একাধিক রোহিঙ্গা। 

তবে নোম্যান্স ল্যান্ডের এই শরণার্থী শিবিরকে একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া করতে ৩৬ জন মাঝি (দল প্রধান) নির্ধারণ করা হয়েছে। ৫০টি পরিবার নিয়ে একজন মাঝি টিম প্রধান হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত। ওই পরিবারগুলোর জন্য ত্রাণসহ নানা সমস্যাগুলো নিরসনে ভূমিকা পালন করছেন মাঝি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী বিজিবি ক্যাম্পে নিবন্ধন শেষে মাঝিদের মাধ্যমেই পরিবারগুলোকে দেওয়া হচ্ছে।

 

সর্বশেষ খবর