শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গভীর সমুদ্রে আটকে টাকা দাবি, না পেয়ে নৌকাডুবি, ২১ লাশ উদ্ধার

মূল্যহীন ওদের জীবন

মাহমুদ আজহার ও ফারুক তাহের, উখিয়া থেকে

মূল্যহীন ওদের জীবন

নৌকাডুবিতে মৃতদের সারি। অধিকাংশই শিশু। কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানীতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে গতকাল হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। স্বজন হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এক নারী (নিচে) —রোহেত রাজীব

গত বুধবার রাত ৮টা। মিয়ানমারের বুছিদং থানার একটি পাড়া থেকে শতাধিক লোক এসে জড়ো হন নাইক্কনদিয়া দ্বীপে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর তাণ্ডব সইতে না পেরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। নাফ নদে পারাপারের চার বাংলাদেশি মাঝি তাদের পার করে দিতে সম্মতও হয়। যথাসময়ে নৌকাতেও ওঠেন রোহিঙ্গারা। নাইক্কনদিয়া থেকে শাহপরীর দ্বীপে আসতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। এপার থেকে ওপার দেখাও যায়। কিন্তু নৌকা বোঝাই চার মাঝি শাহপরীর দ্বীপে না গিয়ে সরাসরি চলে যায় গভীর সমুদ্রে। রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্যই এ কাণ্ড। তারপর জনপ্রতি দশ হাজার করে টাকা দাবি করা হয়, যা অনেকের পক্ষেই দেওয়া অসম্ভব ছিল। এ কথাগুলো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ‘জ’ আদ্যাক্ষরের এক রোহিঙ্গা যুবকের। কথাগুলো যখন তিনি বলছিলেন, তখন তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। তার কথা অনুযায়ী, শেষমেশ একরাত একদিন পর উত্তাল সমুদ্র কেড়ে নেয় ২১ প্রাণ। এরমধ্যে শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি। গতকাল এই লাশের সারির দেখা মেলে উখিয়ার বড় ইনানী বিচ এলাকায়। সহস াধিক মানুষ জানাজায় অংশ নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় আশপাশে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে ১৭টি মরহেদ উদ্ধার করা হয়। গতকাল সকালে ইনানী বিচের আশপাশে পাওয়া যায় চারটি লাশ। এর মধ্যে ছিল তিনজন শিশু ও একজন কিশোরী। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের সবাইকে বড় ইনানী করবস্থানে দাফন করা হয়েছে। গত এক বছরে এভাবে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গার করুণ মৃত্যু হয়েছে সাগরে। যার সঙ্গে জড়িত ওই দুষ্ট মাঝি ও স্থানীয় কিছু দালাল শ্রেণির জনপ্রতিনিধি। গতকাল সকাল ৯টায় সরেজমিন বড় ইনানী বিচ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে মরদেহগুলো সারিবদ্ধভাবে রাখা। এক পর্যায়ে কয়েকজন স্থানীয় নারী ও পুরুষ মুসলিম ধর্মীয় রীতিতে গোসল করান। এরপর সকাল ১০টার দিকে প্রথম ধাপে ১৯ জনের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে আরও দুজনের দাফন হয়। রোহিঙ্গাদের মৃতদেহগুলো যখন কবরের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কান্নার রোল পড়ে যায়।

উখিয়া ও টেকনাফ ঘুরে দেখা গেছে, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্থানীয় এলাকাবাসীও তাদের বসতবাড়িতে জায়গা দেওয়াসহ খাবার সামগ্রী বিতরণ করছেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে সর্বস্তরের মানুষ রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিচ্ছেন। মিয়ানমারে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারও অস্থায়ীভাবে তাদের বসতি তৈরি করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণের জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশসহ স্থানীয় জেলা প্রশাসন দিনরাত পরিশ্রম করছে। কিন্তু গুটি কয়েক দুষ্টচক্র বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুুণ্নের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এটা করতে গিয়ে তারা রোহিঙ্গাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। এরমধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছে নৌকার মাঝি। শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় কিছু জনপ্রতিনিধিও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। সরকারি পাহাড় কেটে রোহিঙ্গাদের টাকার বিনিময়ে তাঁবু নির্মাণ, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা গরু পানির দামে কিনে চড়া দামে বিক্রিসহ নানা ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে এরা। এই চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন স্থানীয় জনসাধারণ।

‘জ’ আদ্যাক্ষরের রোহিঙ্গা যুবক কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, গভীর সমুদ্রে যখন নৌকা তখন সহযাত্রী এক বৃদ্ধ রোহিঙ্গা মাঝিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ভুল পথে নৌকা চালাচ্ছেন। আমরা যেখান থেকে উঠেছি, সেখান থেকে বাংলাদেশের সীমান্ত দেখা যায়।’ উত্তরে মাঝি ধমক দিয়ে বলে, ‘পথ আমার চেয়ে আপনি ভালো চেনেন না। চুপ করে বসে থাকুন।’ চুপসে যান ওই বৃদ্ধ। রাত ক্রমেই গভীর হয়। নৌকাটি ততক্ষণে গভীর সমুদ্রে। রোহিঙ্গাদের কাছে কোনো খাবারও ছিল না। না খেয়েই রাত পাড় করে তারা। পরের দিন সকালেও রোহিঙ্গারা লক্ষ্য করে— চারপাশে অথৈ পানি। এ সময় মাঝিরা তাদের জানায়, জনপ্রতি ১০ হাজার করে টাকা দিতে হবে। রোহিঙ্গারা জানান, এত টাকা তাদের কাছে নেই। তখন মাঝি বলে, ‘আপনাদের পরিবারের মধ্যে যারা অস্ট্রেলিয়া কিংবা মালয়েশিয়ায় থাকেন, তাদের ফোন দেন। টাকা না দিলে নৌকা ঘাটে যাবে না।’ এ সময় তারা কিছু সময়ও বেঁধে দেয়।

যুবক আরও জানান, নৌকার মালিক শিলখালির আবদুল হামিদও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। কারণ নৌকার মাঝিরা মাঝেমধ্যেই হামিদের সঙ্গে কথা বলছিল। জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পেতে দু-একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা মালয়েশিয়ায় ফোনও দিয়েছে। সেখান থেকে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও মেলে। মাঝিরা নৌকার মালিক হামিদের বিকাশ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে দেয়। কিন্তু যথাসময়ে টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা বিকাশে আসেনি। তাই আবারও টালবাহানা করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গভীর সমুদ্রেই নৌকাটি আটকে রাখে মাঝিরা। পরের দিনও যায় আধাবেলা। কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি অস্ট্রেলিয়া কিংবা মালয়েশিয়ায়। যুবক জানান, এরই মধ্যে উত্তাল হতে থাকে সমুদ্র। এক পর্যায়ে শুরু হয় সমুদ্রের গর্জন। শুরু হয় ঝড়বৃষ্টি। সবারই জীবন তখন যায় যায় অবস্থা। নৌকার মাঝিরাও তখন বিপদে। তারা ঢেউয়ের তালে তালে কোনোমতে নৌকাটি উখিয়ার দিকে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। কিন্তু প্রচণ্ড ঢেউয়ের কারণে কোথাও নৌকাটি নোঙ্গর করতে পারছিল না। দুই দিন দুই রাতের ক্ষুধা আর জীবননাশের হুমকিতে শুরু হয় কান্নাকাটি। ততক্ষণে নৌকাটি উখিয়ার ইনানী বিচের কাছাকাছি পাটুয়ারটেক এলাকার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। কিন্তু ঝড়ের কারণে নৌকা কূলে আনতে পারছিল না চার মাঝি। এ সময় ভাটার এক ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা উল্টে পড়ে। শিশু নারীসহ সবাই হাবুডুবু খেতে থাকে। ভাটার টানে অতল সমুদ্রের দিকে চলে যেতে থাকে রোহিঙ্গারা। যুবক বলেন, ‘আমাকেও উদ্ধার করে স্থানীয় জনগণ। তবে আমার দুই শিশু আর আমার স্ত্রীকে আর ধরে রাখতে পারিনি। তারা শেষ পর্যন্ত লাশ হয়ে ফেরে।’ ওই এলাকায় মেরিন ড্রাইভ সড়কের ওপারে খলিল আহমদ নামে এক দোকানদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকের ঘটনা। তিনি প্রথমে মনে করেছিলেন, মাঝিরা মাছ ধরছে। কিন্তু এক পর্যায়ে যখন মানুষের ডুবুডুবু মাথা দেখা যাচ্ছিল, তখন ইনানী বিচসহ আশপাশের সবাইকে নিয়ে সমুদ্রের দিকে দৌড়ে যান। গিয়ে দেখেন, প্রায় ১০০ রোহিঙ্গার আর্তনাদ। তখন ২৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। প্রথম পর্যায়ে ১৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর পুলিশসহ পর্যায়ক্রমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসে। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে ভাটা শুরু হয়। তখন বন্ধ হয়ে যায় উদ্ধার তৎপরতা।  জীবিত উদ্ধার হওয়া উখিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মুইদং এলাকার আবুল কালাম (৪৫) বলেন, ‘আমীর সাহেব নামের একজন লোক মালয়েশিয়া থেকে ফোন করে আমাদের বোটে উঠে বাংলাদেশে চলে আসার কথা বলেন।’ তিনি টাকা-পয়সা সব বোট মালিককে দিয়ে দিয়েছেন বলেও জানান। কিন্তু তারপরও কেন নৌকাটি গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয়— তা বোধগম্য নয়। তিনি আরও বলেন, ‘নৌকায় আমার স্ত্রী, ছেলে, মেয়েসহ সাতজন ছিলাম। আমি এবং আমার দ্বিতীয় মেয়ে জীবিত উদ্ধার হলেও স্ত্রী ফিরোজা খাতুন (৪০), মেয়ে শাহেদা (১৪) মারা যায়। তাদের লাশ পাওয়া গেলেও আরেক মেয়ে ছেনুয়ারা বেগম (৯) এখনো নিখোঁজ রয়েছে। আমার শ্যালক মো. কাশিমও জীবিত। কিন্তু তার স্ত্রী শাহজান খাতুন (৩৫) এবং তাদের আড়াই বছরের শিশু রুখিয়া ও আরেকটি ৭ বছরের শিশু মারা যায়।’ মুইদং এলাকার জামাল হোসেনের স্ত্রী রাশেদা বেগম উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনোমতে কূলে আসতে পারলেও সাত মাসের মোহাম্মদ হোসাইন ছিটকে পড়ে সাগরে নিখোঁজ হয়ে যায়। হোসাইন বেঁচে আছে কিনা জানি না।’ তার পাশেই বেডে শুয়ে থাকতে দেখা যায় জীবিত উদ্ধার আরেক রোহিঙ্গা যুবতী মিয়ানমারের বুচিদং থানার একই এলাকার আমিনা খাতুন (১৮)। তিনি জানান, তার পিতা লালু মিয়া এবং ভাই জাফর আলম বেঁচে আছেন। কিন্তু তার ভাবী জাফর আলমের স্ত্রী তৈয়বা খাতুন, তাদের যমজ ২ সন্তান নুর কামাল ও জুবাইদা খাতুন মারা গেছে। তিনি জানান, তারা জনপ্রতি মিয়ানমারের ২০ হাজার কিয়াত (টাকা) ভাড়া করে এদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝপথে নৌকার মাঝি তাদের নির্দিষ্ট স্থানে না নিয়ে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে  কক্সবাজারের দিকে নিয়ে আসে।  উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, উদ্ধার হওয়া লাশগুলো স্থানীয় গ্রামবাসীর সহযোগিতায় উপকূলের বড় ইনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আর জীবিত উদ্ধারকৃতদের উখিয়া ও কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ঘটনা পরম্পরায় : ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভূমধ্যসাগরের উপকূলে সিরীয় শরণার্থী শিশু আইলান কুর্দির মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা একটি ছবি গোটা বিশ্বমানবতাকে নাড়া দিয়েছিল। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর তিনটি নৌকাডুবির ঘটনায় দুই শিশু ও এক নারীর লাশ পাওয়া গেলেও আরও  অর্ধশত  নিখোঁজ রয়ে যায়। সে ঘটনায় নাফ নদের এপাড়ে শাহপরীর দ্বীপ উপকূলের কাদামাটিতে মোহাম্মদ সোহায়েত নামের এক রোহিঙ্গা শিশুর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার ছবিও বেশ আলোড়ন তোলে। গত ৩০ আগস্ট ভোরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহনকারী একটি নৌকা নাফ নদে ডুবে গেলে সাতজন শরণার্থীর মৃত্যু হয়। ওই নৌকায় অন্তত অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা ছিল। ৩১ আগস্ট আরও দুটি নৌকাডুবির ঘটনায় লাশ উদ্ধার হয় ২৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর। গত ৫ সেপ্টেম্বর অপর একটি নৌকাডুবির ঘটনায় শাহপরীর দ্বীপ উপকূল থেকে ৫ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৩ সেপ্টেম্বর নৌকাডুবির ঘটনায় সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ এলাকার জালিয়ারপাড়ামুখ পয়েন্ট থেকে দুই শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। গত ৬ সেপ্টেম্বর নাফ নদের তুলাতলী ও শাহপরীর দ্বীপের উপকূলের ১১ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

# রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেছেন উখিয়ার শফিক আজাদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর