শনিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা সংকটে অর্থনৈতিক কূটনীতি চালাতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা সংকটে অর্থনৈতিক কূটনীতি চালাতে হবে

আবুল বারকাত

রোহিঙ্গা সংকটে রাজনৈতিকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতিও চালানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত। তিনি গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা করছিলেন।

আবুল বারকাত বলেন, ‘যদিও আমরা কূটনীতিবিদ নই, তবু আমরা মনে করি রাজনৈতিক কূটনীতি দিয়ে পুরো সমস্যার সমাধান হবে না। রাজনৈতিক কূটনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি, ইকোনমিক ডিপ্লোমেসি চালানো ভালো হবে।’ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রতিবাদে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এখানে বক্তৃতাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বারকাত রোহিঙ্গা সমস্যা মোচনে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি ‘গ্রিন রুমের’ কূটনীতিকে কাজে লাগানোর ওপর  গুরুত্বারোপ করেন। একই সঙ্গে তিনি দেশীয় ঐক্য ধরে রাখারও পরামর্শ দেন। অধ্যাপক বারকাত বলেন, ‘আলোচনা দ্বিপক্ষীয় করতে হয়, বহুপক্ষীয়ও করতে হয়। এ বিষয়গুলো কাজে লাগে। আনুষ্ঠানিক আলোচনা যখন হয়, তখন অনেকে অনেক কথা বলেন, অনেক মত দেন, অনেক ভালো কথা বলেন। কিন্তু আসল কাজটা হয় গ্রিন রুমে।’ বিভিন্ন দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে বিশ্ব জনমত গঠনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা কেবল অর্থনৈতিক বিষয় নয়। এটার যে পরিবেশগত প্রভাব— তাও আছে, তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘ থেকে বক্তব্য এসেছে। আসিয়ান অঞ্চলের যে দেশগুলো, সেখানে প্রভাবটা পড়েছে। সে জন্য তাদের সম্পৃক্ত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে।’ ‘কৌশলগত কারণে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো নিজের অবস্থান ব্যক্ত করছে’ জানিয়ে আবুল বারকাত বলেন, ‘পৃথিবীতে চারটি কৌশলগত সম্পদ— ভূমি, জলা-সাগর, খনিজ জ্বালানি সম্পদ এবং স্পেস মহাকাশ। এই চারটি সম্পদের ওপর অ্যাবসোলিউট ওনারশিপ, অ্যাবসোলিউট কনট্রোল এটা নিশ্চিত করতে চায় বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হোতা সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একক কোনো সিস্টেম নয়। পেরি-ইম্পেরিয়ালিজম, সেমি-ইম্পেরিয়ালিজম, কম্পিটেটিভ ইম্পেরিয়ালিজম তৈরি হচ্ছে। চীন, রাশিয়া, ভারত— এটা কম্পিটেটিভ ইম্পেরিয়ালিজম কিনা? যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে এসব এলাকায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ থেকে শুরু করে মুক্তবাণিজ্য প্রভৃতিকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবেই।’ চীন-ভারতের স্বার্থের কথা উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘চীনের বিনিয়োগ বেশি মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টে। বিনিয়োগ কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার। ভারতের বিনিয়োগ আছে কয়েক বিলিয়ন ডলার। এটা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের প্রাকৃতিক সম্পদ, গ্রেসিয়াম, ইউরেনিয়াম আছে। আবার বঙ্গোপসাগরের সংযোগকারীও। রাখাইন রাজ্যের ইউরোনিয়াম সবচেয়ে গুণগত মানসম্পন্ন হওয়ায় বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, সেখানকার ইউরেনিয়ামের ওপর চীনের নজর বহু আগে থেকেই আছে। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সরকারি অবস্থানের সমালোচনা করে অধ্যাপক বারকাত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শরণার্থী বলছেন, এখন বলা হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী। অনুপ্রবেশকারী বললে দায়-দায়িত্ব আসে না। শরণার্থীর একটা সংজ্ঞা আছে, আন্তর্জাতিক সভ্য সমাজের সদস্য হিসেবে আমাদের একটা দায়-দায়িত্ব থাকে, আমি তাদের শরণার্থী বলি। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় আর কি! নিঃসন্দেহে তারা শরণার্থী। তাদের শরণার্থীর মর্যাদা দিতে হবে। তারা তো এমনি এমনি চলে আসেনি।’ লিখিত বক্তব্যে মিয়ানমার সরকারের প্রতি রাখাইনে হত্যাযজ্ঞ বন্ধের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশকে এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান আবুল বারকাত। তিনি বলেন, ‘আমরা ভারত, গণচীন, রাশিয়া, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব বৃহৎ ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের নেতাদের কাছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাবিরোধী হত্যাযজ্ঞ বন্ধ এবং বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের অবিলম্বে তাদের নিজ দেশে ফেরত নেওয়ার জন্য সর্বাত্মক কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ ও প্রভাব বিস্তারের আহ্বান জানাচ্ছি।’

আবুল বারকাত আরও বলেন, ‘মিয়ানমারে চলমান রোহিঙ্গাবিরোধী নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ওখানকার স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে।’ রোহিঙ্গা নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সেখানকার স্বৈরশাসক-যুদ্ধাপরাধীদের ‘বিদেশে ব্যাংক হিসাব জব্দ’ করার দাবি জানান এই অর্থনীতিবিদ। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর