মঙ্গলবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

অভিযোগের পাহাড়ে এসআইবিএল

জরুরি বোর্ড সভায় পদত্যাগ চেয়ারম্যান-এমডির, দীর্ঘদিনের অনিয়ম নিয়ে তদন্ত শুরু

আলী রিয়াজ

অভিযোগের পাহাড়ে এসআইবিএল

মো. রেজাউল হক

অভিযোগের পাহাড় নিয়ে পদত্যাগ করলেন সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মো. রেজাউল হক, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মো. আনিসুল হক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদ হোসেন। নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ারুল আজিম আরিফ। নতুন এমডি হয়েছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের অতিরিক্ত এমডি ওসমান আলী। এ ছাড়া নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ সদস্যদের এক জরুরি বৈঠকে ব্যাপক অভিযোগ উত্থাপনের পর তিনি পদত্যাগ করার কথা ঘোষণা দেন। ২০১৩ সালে ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে রেজাউল হক ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে ব্যাংকটিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছেন। অবৈধ সুবিধা, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে নাশকতায় অর্থায়ন করেছেন এসআইবিএলের চেয়ারম্যান রেজাউল হক। আইন ভঙ্গ করে এক শতাংশের নিচে শেয়ার ধারণ করেও চেয়ারম্যান পদ আঁকড়ে ছিলেন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল জরুরি বৈঠকে বসে ব্যাংকের পর্ষদ।

সূত্র জানান, ব্যাংকটির বর্তমান পর্ষদ সদস্য ও নীতিনির্ধারকদের সহযোগিতায় নামে-বেনামি প্রতিষ্ঠানে ঋণ দিয়ে বিদেশে পাচার করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালের পর দেশের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির সহায়ক হিসেবে যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে তার অন্যতম এসআইবিএল। বিশেষ করে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে নাশকতা কর্মকাণ্ডে ব্যবহূত বিপুল অর্থের উৎস হিসেবে নাম এসেছে এই ব্যাংকটির। ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তাদের পাশ কাটিয়ে করপোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) তহবিলের টাকার পুরোটাই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ব্যয় করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে দেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। ফলে ব্যাংকের লক্ষাধিক গ্রাহকের আমানত আজ হুমকির মুখে পড়েছে।

এসআইবিএল, দুদক ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, রেজাউল হক প্রতিদিন মতিঝিলে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে বসেন। ব্যাংকের সব কর্মকাণ্ডে তিনি হস্তক্ষেপ করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ব্যাংকের পরিচালকমণ্ডলীর কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেন না। যেসব কর্মকর্তা পরিচালকদের কথামতো কাজ করেন না তাদের শাস্তির মুখে পড়তে হয়। চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মো. রেজাউল হক নিজ প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকের অর্থ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করেন। যার কোনো জবাবদিহিতা নেই। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বাসিন্দা রেজাউল হক ১৯৮৩ সালে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে যান। পরে সৌদি আরবে তিনি একটি হাসপাতালে চাকরি করেন। দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে দেশে ফিরে এসআইবিএলের সঙ্গে যুক্ত হন। সৌদি আরবে থাকার সময় থেকে তিনি ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ, লে. কর্নেল (অব.) নূর চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল তার। ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে কুমিল্লার চান্দিনা আসনে ফ্রিডম পার্টির এমপি প্রার্থী কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদকে মুক্ত হাতে আর্থিক সহযোগিতা করেন রেজাউল হক। ভোটের কয়েক দিন আগে নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে রেজাউল হক নিজেই কর্নেল (অব.) রশীদের পক্ষে প্রচার চালান ও ভোটারদের মধ্যে টাকা বিলি করেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে জানা গেছে, রেজাউল হক রাজনৈতিক অপচেষ্টা, নাশকতা ও দুরভিসন্ধি চরিতার্থে বিএনপি কর্মী, ভূতপূর্ব ফ্রিডম পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী ও জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে গোপনে বিশাল অঙ্কের তহবিল দেন। এ ছাড়া ২০১২ সালে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য পেট্রলবোমা তৈরির খরচের টাকার জোগানদাতা হিসেবে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালে চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে ব্যাংকের প্রচুর টাকা তসরুপ করে এই নাশকতার কর্মকাণ্ডে ব্যয় করেন। সিএসআর ফান্ডের পুরো অর্থই এককভাবে ব্যয় করেছেন তিনি। অভিযোগ উঠেছে, এ টাকার পুরোটাই জঙ্গি কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা হয়েছে। ব্যাংকের এই ফান্ডের অর্থায়ন সম্পর্কে কোনো হিসাব পর্যন্ত নেই। জানা গেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী তিনি। যে কোনো উপায়ে দলের মনোনয়ন পেতে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিভিন্ন ব্যক্তিকে ‘হাত’ করার লক্ষ্যে তাদের নামে মর্টগেজ ছাড়াই নিয়মনীতি ভঙ্গ করে শত শত কোটি টাকার ঋণ দিয়েছেন।

চেয়ারম্যান হয়ে যা যা করলেন

১. সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমানকে (চলতি বছরের শুরুতে অবসরে যান) চেয়ারম্যান বাম হাত হিসেবে ব্যবহার করে ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়মকে বৈধতা দিয়েছেন। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের নামে আমানতকারীদের টাকা হুজি জঙ্গিদের নাশকতামূলক কার্যক্রমে বিভিন্ন ধাপে অর্থায়ন করেছেন।

২. অন্যায় চাপা দিয়ে বিতর্কিত বিএনপি ও জামায়াত-শিবির সমর্থকদের ব্যাংকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। নীতিমালা ভঙ্গ করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দিয়েছেন। রাজনৈতিক পরিচয়ে ব্যাংক পর্ষদে আধিপত্য বিস্তার করার অপচেষ্টা করেছেন।

৩. চেয়ারম্যান ২০১৫ সালে ব্যাংকের অর্থে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা দিয়ে নতুন মডেলের একটি গাড়ি কেনেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম ভঙ্গ করে এই গাড়ি তিনি ব্যবহার করছেন। ২০১৭ সালের এপ্রিলে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকায় আরও একটি নতুন মডেলের গাড়ি কেনেন। নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য চেয়ারম্যান বোর্ডের অনেক পরিচালককে তাদের ব্যবহারের জন্য উপহার দিয়েছেন কোটি টাকা মূল্যের দামি গাড়ি। উপহারপ্রাপ্ত পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন রাব্বান আলী, জাব্বার মোল্লা ও আনিসুল হক। আবদুল আউয়াল পাটোয়ারি নামে একজনকে পরিচালক বানিয়েছেন, যার বিরুদ্ধে রয়েছে সোনা চোরাচালানের অভিযোগ। এ অভিযোগে আবদুল আউয়ালের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে।

৪. গত তিন বছরে প্রায় ৩৫০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেন, যাদের প্রত্যেকের থেকে নিয়েছেন ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা করে।

৫. সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনার নামে ব্যাংক থেকে ৮০ কোটি টাকা মুনাফাবিহীন ঋণ দেওয়া হয়েছে। এটা পুরোপুরি আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থের পরিপন্থী। রেজাউল হকের স্ত্রী হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফাউন্ডেশনের পরিচালক। তিনি নিয়মিত ব্যাংক থেকে বেতন-ভাতাদি নিচ্ছেন। এই হাসপাতালে প্রায় ৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যাংক থেকে এদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়।

৬. ২০১৬ সালের বার্ষিক রিপোর্ট বই ছাপানোর জন্য প্রতি কপি ৩৫৫ টাকা হারে ৮০ হাজার বই ছাপানো বাবদ বিল দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, বাস্তবে ৫ হাজার বইও ছাপানো হয়নি। এ ছাড়া ক্যালেন্ডার ছাপানোর নাম করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

৭. তারেক মুর্শেদ নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিসের যাবতীয় খরচ চেয়ারম্যান বহন করে থাকেন। ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ চৌধুরী বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ২০১৫ সালের ২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দেন।

৮. ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার মির্জার ফারহানা টেক্সটাইল মিলস ও নোয়াখালী অয়েল মিলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ৩২.৩০ একর সরকারি জমি (যার আনুমানিক মূল্য ৬০২ কোটি ৯২ লাখ টাকা) বন্দোবস্ত নিয়ে লিজ দলিলের শর্ত ভঙ্গ করে জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে ভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে।

৯. সম্প্রতি গোলাম কবির নামে ৭৮ বছর বয়সী দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী ব্যক্তিকে ৬৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছেন। টপটেন টেইলার্স নামক একটি সেলাইকারী প্রতিষ্ঠানকে ১৬০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন বিনা জামানতে। ধানমন্ডির আনোয়ারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা খেলাপি। তবুও ওই প্রতিষ্ঠানকে আবারও ১৬৮ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে।

১০. রেজাউল হকের আরেক ঘনিষ্ঠ সহযোগী ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান মো. আনিসুল হক। জামায়াত মতাদর্শী এই ব্যক্তি হামদর্দ ল্যাবরেটরিজের পরিচালক (অর্থ)। হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের মাধ্যমে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে অস্বচ্ছতা, চেয়ারম্যান এবং কতিপয় পরিচালকের স্বেচ্ছাচারিতা, আর্থিক অনিয়ম ও সম্ভাব্য নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অর্থায়নে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের সম্পৃক্তার বিষয়টি তদন্তে উঠে এসেছে।

১১. পানামা টেক্সটাইল মিলস লি. এসআইবিএলের ইস্কাটন শাখার একজন ঋণগ্রহীতা। ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এই কোম্পানির চলতি মূলধন হিসেবে এত টাকা প্রযোজ্য নয়, তবুও ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ফান্ড ডাইভারশন করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা, যা সম্পূর্ণ মানি লন্ডারিং। আল-আমীন বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লি. বাবুবাজার শাখার একজন ঋণগ্রহীতা। অন্য ব্যাংকে ঋণখেলাপি হওয়া সত্ত্বেও রহস্যজনকভাবে তাদের প্রায় ৪০ কোটি টাকার অধিক ব্যাংকের বিভিন্ন মোডে অনিয়মিতভাবে ঋণ প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, তারেক মুর্শেদ ওখঈ-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান দুটিতে মূলত এর ফান্ড অ্যাকোমোডেশনের ব্যবস্থা করে দেন, কেননা বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরীণ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি খুলে একই দিনে ডকুমেন্ট তৈরি, উক্ত ডকুমেন্ট আইবিপির মাধ্যমে বাবুবাজার, মাধবদী ও ভুলতা শাখার মাধ্যমে ডকুমেন্টগুলো কিনে টাকা বের করে নেওয়া হয়।

১২. মারস টেক্সটাইলস লি. আগ্রাবাদ শাখা, চট্টগ্রামের একজন ঋণগ্রহীতা। বকেয়া প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। ব্যাক টু ব্যাক পণ্য আমদানি করে রপ্তানি না করে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে, যা গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ।

১৩. মুস্তফা করপোরেশন খাতুনগঞ্জ শাখার একজন ঋণগ্রহীতা। ব্যাংকের পাওনা ১১৫ কোটি টাকা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোকাল এলসির মাধ্যমে মালামাল সরবরাহ দেখানো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে কোনো মালামাল সরবরাহ হয়নি। মুস্তফা গ্রুপের কর্মচারীদের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে সেসব এলসির টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।

সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অনিয়মের উদাহরণ

১. বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বেনামি দুটি স্থায়ী আমানত যার নম্বর ০৩২১৯৭/৫৩১-৭৫৭১ (৫০ লাখ টাকার) ও ০৩২১৯৮/৫৩১-৭৫৮৬ (২৩ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকার) তারিখ : ১৭.০৭.২০১৭ জনৈক মো. মমিন উদ্দিনের নামে ছিল। ব্যাংকের চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত প্রভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুমতি ছাড়াই ওই দুটি এমটিডিআর হাল নগদ মুনাফাসহ প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে দেওয়া হয়। দুদকের অনুমতি ছাড়া এবং সংশ্লিষ্ট মামলার চূড়ান্ত ফয়সালা ছাড়া টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও জালিয়াতি করে এই টাকা পরিশোধ করা হয়।

২. এসআইবিএলের বেগম রোকেয়া সরণি শাখায় ফয়েজ উদ্দিন অ্যান্ড কোং নামের একটি প্রতিষ্ঠান এলসির মালামাল দুবাই থেকে দেশে পৌঁছেনি অথচ বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাবেক ডিএমডি এবং বিনিয়োগ বিভাগের ইনচার্জ থাকায় তার নির্দেশে উক্ত এলসির মূল্য প্রদান করা হয়। বিষয়টি মানি লন্ডারিংয়ের স্পষ্ট উদাহরণ।

৩. একটি বৃহৎ রিয়েল এস্টেট কোম্পানির এসআইবিএল গুলশান শাখার প্রায় ১০০ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ আছে। নারায়ণগঞ্জের একটি ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বন্ধক রেখে তাদের ঋণ দেওয়া হয়েছে, যদিও সেই প্রজেক্টের কাজ শুরুই হয়নি। এমনকি প্রজেক্টের জমির মালিক তার পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিল করে দিয়েছেন।

৪. মিল্টন ট্রেডিং এসআইবিএল গুলশান শাখার একজন ঋণগ্রহীতা। কী উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়েছেন, কী কাজে ঋণটি ব্যবহার করেছেন তার কোনো হদিস ব্যাংকের কাছে নেই। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

৫. ডং ব্যাং ডাইং লি. এসআইবিএল গুলশান শাখার ঋণগ্রহীতা। তারা সোয়েটারের সুতা ডাইং করে রপ্তানিমুখী সোয়েটার ফ্যাক্টরির কাছে রপ্তানি করে থাকে। তারা ইচ্ছামতো আমদানি এলসি খুলে মালামালগুলো রপ্তানি না করে ফান্ড ডাইভারশন করছে। এভাবে মালামাল ঘাটতির পরিমাণ কোটি কোটি টাকা। এই কোম্পানির একজন ডিরেক্টর ছিলেন কোরিয়ান, তিনি কোটি কোটি টাকা এলসির নামে বিদেশে পাচার করেছেন। বর্তমানে ব্যাংকের পাওনার পরিমাণ ৩০০ কোটি টাকার ওপর। এ ধরনের বৈদেশিক মুদ্রার তসরুপ মানি লন্ডারিংয়ের পর্যায়ে পড়ে।

৬. সাস ফ্যাশন ওয়ার লি. একটি রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস এবং এসআইবিএল বনানী শাখার একজন ঋণগ্রহীতা। ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২৫ কোটি টাকা। রপ্তানির জন্য মালামাল আমদানি করে তা রপ্তানি না করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্টক লটের মালামালের কোনো হদিস নেই। এ ধরনের কার্যক্রম ফৌজদারি অপরাধ ও মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় পড়ে।

৭. ইব্রাহিম কনসোর্টিয়াম এসআইবিএলের প্রিন্সিপাল শাখার একজন ঋণগ্রহীতা। ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১১০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ এলসির মাধ্যমে মালামাল সংগ্রহ দেখানো হলেও আসলে কোনো প্রকার মালামালের লেনদেন হয়নি।

৮. ওপাল ট্রেডিং হাউস গুলশান শাখার ঋণগ্রহীতা। বতর্মানে পাওনা প্রায় ৯০ কোটি টাকা। ব্যাংকের টাকা পাচার করে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক কানাডায় বাড়ি কিনেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

৯. খলিল ট্রেডার্স প্রিন্সিপাল শাখার একজন ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা প্রায় ২৪ কোটি টাকা। ঋণ গ্রহণের পর বর্তমানে নিখোঁজ অবস্থায় আছেন।

১০. মীম এন্টারপ্রাইজ জিইসি মোড় চট্টগ্রাম শাখার ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ এলসির পণ্য সরবরাহ দেখানো হলেও আসলে কোনো প্রকার পণ্যের লেনদেন হয়নি, শুধু কাগজের লেনদেন হয়েছে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির কায়দায় ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিক এখন বিদেশে পলাতক।

১১. এস কে স্টিল জিইসি মোড় চট্টগ্রাম শাখার ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা প্রায় ৬০ কোটি টাকা। শিপ ব্রেকিংয়ের জন্য ঋণ নিয়ে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

১২. ফরচুন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড চকবাজার শাখা চট্টগ্রামের ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা প্রায় ৪৪ কোটি টাকা। উক্ত প্রতিষ্ঠান শিপ ব্রেকিংয়ের জন্য ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে।

১৩. মরিয়া স্টিল জুবলি রোড চট্টগ্রাম শাখার ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকা। শিপ ব্রেকিংয়ের জন্য ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছে।

১৪. ইস্টার্ন করপোরেশন আগ্রাবাদ শাখা চট্টগ্রামের ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। কী উদ্দেশ্যে ঋণ প্রদান করা হয়েছে তা স্পস্ট নয়। ঋণ গ্রহণ করে তা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করেছে।

১৫. সুপার সিক্স শিপ ব্রেকার্স আগ্রাবাদ চট্টগ্রাম শাখার ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক বর্তমানে ঋণ গ্রহণ করে পরিশোধ না করে বিদেশে পলাতক আছেন।

১৬. কুমরা শিপ ব্রেকিং লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা চট্টগ্রামের ঋণগ্রহীতা। ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে বর্তমানে পাওনা প্রায় ২১ কোটি টাকা। শিপ ব্রেকিংয়ের জন্য ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করে বিদেশ পালিয়ে গেছেন।

১৭. ইয়াসিন এন্টারপ্রাইজ আগ্রাবাদ শাখা চট্টগ্রামের ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা প্রায় ২৬ কোটি টাকা। শিপ ব্রেকিংয়ের জন্য ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

১৮. লিজেন্ড টেক্সটাইল লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা চট্টগ্রামের একজন ঋণগ্রহীতা। প্রতিষ্ঠানটির বকেয়া প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

১৯. আহমদ মুজতবা স্টিল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা চট্টগ্রামের ঋণগ্রহীতা। এর কাছে পাওনা ৩৫ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি শিপ ব্রেকিং ব্যবসার জন্য ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে সিঙ্গাপুরে পাচার করেছে।

২০. মাইল ফেব্রিক্স লিমিটেড আগ্রাবাদ শাখা চট্টগ্রামের ঋণগ্রহীতা এবং বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা ১৩ কোটি টাকা। রপ্তানির জন্য আমদানি এলসি খুলে তা রপ্তানি না করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

২১. দত্ত এন্টারপ্রাইজ বগুড়া শাখার ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে ব্যাংকের পাওনা ৪৫ কোটি টাকা। ভারত থেকে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলে আমদানি মূল্য পরিশোধ না করে গোপনে পোর্ট থেকে মাল খালাস করে তা বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করেছে।

২২. লিটন ট্রেডার্স বগুড়া শাখার ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে ব্যাংকের পাওনা ৩০ কোটি টাকা। ভারত থেকে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলে আমদানি মূল্য পরিশোধ না করে গোপনে জালিয়াতির মাধ্যমে বন্দর থেকে মালামাল খালাস করে তা বাজারে বিক্রি করে দিয়ে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করা হয়েছে, এটা গুরুতর অপরাধ।

২৩. মরিয়ম স্পিনিং মিলস লিমিটেড মাধবদী, নরসিংদী শাখার ঋণগ্রহীতা। বর্তমানে পাওনা ৫৫ কোটি টাকা। ব্যাংকের ঋণ নেওয়ার পর আর পরিশোধ করছে না। স্পিনিং মিলে সব টাকা বিনিয়োগ করলে একটি মিলের অবস্থা এ রকম খারাপ হওয়ার কথা নয়। এখানে ফান্ড ডাইভারশন করে অন্যত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করে নানা টালবাহানা করা হচ্ছে। এসব জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে এসআইবিএল চেয়ারম্যান রেজাউল হকের।

সর্বশেষ খবর