রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
কাকরাইলে মা-ছেলে খুন

জনির পরিকল্পনাতেই হত্যা!

যশোর থেকে র‍্যাবের হাতে আটক, বললেন সব কিছু

নিজস্ব প্রতিবেদক

জনির পরিকল্পনাতেই হত্যা!

আল আমিন জনি

রাজধানীর কাকরাইলে চাঞ্চল্যকর মা-ছেলে জোড়া খুনের ঘটনায় আল আমিন জনি (৩৩) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। জনি সম্পর্কে আবদুল করিমের তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তার ভাই। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল ভোরে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই হত্যাকাণ্ডে জনি নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। বর্ণনা করেছেন হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ঘটনা থেকে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত সবকিছুর আদ্যোপান্ত। নিহত শামসুন্নাহার গ্রেফতার ব্যবসায়ী আবদুল করিমের স্ত্রী ও শাওন সন্তান। জনিকে গ্রেফতারের পর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এ নিয়ে গতকাল বিকালে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। অন্যদিকে জোড়া খুনের এ ঘটনায় গ্রেফতারের পর ছয় দিনের রিমান্ডে থাকা শেখ আবদুল করিম ও তার তৃতীয় স্ত্রী শারমিন মুক্তা অসংলগ্ন কথা বলছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। শিগগিরই তাদের তিনজনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানা গেছে।

জনির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, মুক্তা ব্যবসায়ী আবদুল করিমের তৃতীয় স্ত্রী। চার বছর আগে তাদের বিয়ে হয়। মুক্তা তার মা ও ভাই জনিকে নিয়ে নরসিংদীতে থাকতেন। সম্প্রতি তিনি মা-ভাইকে নিয়ে ঢাকায় এসে একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন। ঢাকায় আসার পর থেকে স্বামী করিমের সঙ্গে আর্থিক বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মুক্তার। ব্যবসায়ী করিমের অধিকাংশ সম্পত্তি প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহারের নামে। এ নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। মুফতি মাহমুদ বলেন, র‍্যাবকে জনি জানিয়েছেন, নরসিংদী থেকে ঢাকায় আসার পর নানামুখী সমস্যায় পড়েছিলেন তার বোন শারমিন মুক্তা। তিন-চার মাস আগে করিমের সঙ্গে তার বিবাহবিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঘটনার তিন-চার দিন আগে মুক্তা আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। ওই দিন কাকরাইলের ওই ভাড়া বাসায় করিমও ছিলেন। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখা এবং সর্বশেষ তালাকের প্রক্রিয়ায় শামসুন্নাহারের প্ররোচনা ছিল বলে মনে করতেন জনি ও মুক্তা। এর পরই শামসুন্নাহারকে হত্যার পরিকল্পনা করেন জনি। তবে শামসুন্নাহারকে রক্ষা করতে এগিয়ে গিয়ে প্রাণ হারায় ছেলে শাওন।

যেভাবে হত্যাকাণ্ড : বুধবার সন্ধ্যার কিছু সময় আগে রাজধানীর নিউমার্কেট থেকে ১১০০ টাকায় একটি ছুরি কেনেন জনি। ছুরি নিয়ে সরাসরি চলে যান কাকরাইল ভিআইপি রোডের মায়াকাননে। বাড়িওয়ালার আত্মীয় হওয়ার কারণে বাড়ির দারোয়ান নোমান তাকে কোনো বাধা দেননি। জনি পঞ্চম তলার কলবেল চাপলে কাজের বুয়া রাশিদা দরজা খুলে দিয়ে রান্নাঘরে চলে যান। এ সময় জনি বাইরে থেকে রান্নাঘর আটকিয়ে দেন। জনিকে ছুরি হাতে দেখে চিৎকার করে শাওন। এ সময় শাওনকে ‘টুঁ’ শব্দ না করে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেন জনি। তাতেও কাজ না হলে শাওনের গলায় ও বুকে ছুরিকাঘাত করেন তিনি। এ অবস্থাতেই শাওন বাসা থেকে বের হয়ে মানুষ ডাকতে নিচে নামার চেষ্টা করে। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়ে সে। এদিকে শামসুন্নাহারের কক্ষে ঢুকে তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করতে থাকেন জনি। মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন তিনি। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় বাড়ির দারোয়ানকে জনি বলেন, ওপরে সমস্যা হচ্ছে।

ড্রেস পাল্টে যায় হাসপাতালে : মা-ছেলেকে হত্যার সময় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতের সময় জনির ডানের দুটি আঙুল কেটে যায়। তাজা রক্তে ভিজে যায় তার শরীরের কাপড়। সাধারণ মানুষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজরদারি এড়াতে আগে থেকেই এক সেট কাপড় নিয়ে এসে ঘটনাস্থল-সংলগ্ন একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে রেখে দিয়েছিলেন জনি। পোশাক পাল্টে তিনি প্রথমে আঙুলের চিকিৎসার জন্য কাকরাইল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসার খরচ কমপক্ষে পাঁচ হাজার টাকা শুনে তিনি চলে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে মাসুদ আহমেদ পরিচয়ে টিকিট কেটে ঢাকাতেই এক আত্মীয়ের বাসায় রাতযাপন করেন জনি। ভোর হতেই তিনি সোহাগ পরিবহনে চলে যান গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে। যাওয়ার সময় পদ্মা নদীতে ফেলে দেন রক্তমাখা কাপড়।

জানা গেছে, শামসুন্নাহারকে ২৮ বছর আগে বিয়ে করেন করিম। পরে ফরিদা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন তিনি। ওই সংসারে আকাশ নামে এক পুত্রসন্তান রয়েছে তাদের। ফরিদার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার আগে করিম উত্তরায় তাদের একটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছিলেন। চার বছর আগে মুক্তাকে বিয়ে করেন করিম। শাওন কথাচিত্রের ব্যানারে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতে গিয়েই করিমের সঙ্গে পরিচয় হয় মুক্তার।

তবে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, তৃতীয় বিয়ের পর থেকে শামসুন্নাহার ও ছেলের খোঁজ ঠিকমতো নিতেন না করিম। মুক্তা তিন-চার মাস আগে এই বাড়িতে এসে শামসুন্নাহারকে ভয়ভীতি এবং হত্যার হুমকি দিয়ে গিয়েছিলেন। এদিকে মামলার তদন্ত-তদারক কর্মকর্তা পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করিম ও মুক্তার কথাবার্তায় অসংলগ্নতা রয়েছে। এবার জনিসহ এদের তিনজনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর