রবিবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভুয়া বিল-ভাউচারে শত কোটি টাকা লোপাট এসআইবিএলের

আলী রিয়াজ

বিল ভাউচার দিয়ে কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছেন সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) রেজাউল হক। নিজের দুই সন্তান দেশের বাইরে থাকায় প্রতি মাসেই লন্ডন অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেতেন তিনি। ব্যক্তিগত কাজে এসব ভ্রমণের টাকা তিনি নিয়েছেন ব্যাংক থেকে। এ ছাড়া ব্যাংকের বিভিন্ন ক্রয় ভাউচার দিয়ে অর্থ নিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ভুয়া বিলের সব নথি চেয়েছে।

এসআইবিএল সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৯ মাসে এসআইবিএলে মোট অপারেটিং ব্যয় ছিল ৩৩৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে অন্যান্য ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়েছে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। যে ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই। শুধু অন্যান্য লিখেই এই টাকা হাতিয়েছেন চেয়ারম্যান নিজে। কর্মীদের বেতন বাবদ যেখানে ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি টাকা সেখানে শুধু চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের পেছনে ব্যাংকের ৯ মাসে ব্যয় হয়েছে ৮০ কোটি টাকার বেশি। প্রতি বছর এ ধরনের ব্যয় করেছেন ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন পরিচালক। ২০১৬ সালেও একইভাবে লুটপাট হয়েছে ব্যাংকে। ২০১২ সালে এসআইবিএলের পরিচালকদের ভাতা বাবদ ও অন্যান্য ব্যয় হয়েছে মাত্র ২০ কোটি টাকার কিছু বেশি। এই সময় চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের ভাতা বাবদ ব্যাংকটি ব্যয় করেছে মাত্র ১৫ লাখ টাকা। ২০১৬ সালে এসে অন্যান্য খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। আর ২০১৭ সালে ৯ মাসে এ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি টাকার বেশি। ২০১৩ সালে চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এই ব্যয় প্রতি বছর বৃদ্ধি পেতে থাকে। চেয়ারম্যানের নিজ জেলা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বিভিন্ন রাজনৈতিক কাজে গেলেও সে ব্যয় মেটাত ব্যাংক। প্রতি বছরে একাধিকবার বিদেশ সফরের পুরো ব্যয়ভার বহন করত ব্যাংক। ফলে জ্যামিতিক হারে ভুয়া ভাউচারের বিল বেড়েছে ব্যাংকটিতে। চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত বিদেশ সফরের বিমান ভাড়া থেকে শুরু করে হোটেল বিলের পুরো ব্যয় বহন করেছে ব্যাংক। ব্যাংকের একাধিক পরিচালককে সঙ্গে নিয়ে তিনি এসব লুটপাট চালিয়েছেন। শুধু ভুয়া বিল ভাউচারে লুটপাট নয়, ব্যাংকের প্রতিটি ঋণ মঞ্জুরি থেকে কমিশন নিতেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ডা. রেজাউল হক। ঢাকার নামকরা এক হাসপাতালের উদ্যোক্তা পরিচালক তিনি। অভিজাত এই হাসপাতালেও তিনি দিয়েছেন সিএসআর তহবিলের টাকা। তার প্রভাবে কেউ কোনো কথা বলতে পারত না। কোনো পরিচালক বা কর্মকর্তা এসবে বাধা দিতে চাইলে তাকে পদচ্যুত করা হতো। জানা গেছে, গ্রাহকের টাকা চুরির অভিযোগে কুমিল্লায় অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হলে রেজাউল হক তাকে এসআইবিএলে এনে চাকরি দেন। ওই ব্যক্তি এখন গুলশান এলাকার একটি শাখার ব্যবস্থাপক। আর এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার মাধ্যমেই একাধিক ভুয়া কোম্পানিকে ঋণ দিয়েছেন রেজাউল হক। যার মধ্যে রয়েছে সরকারি জমি বন্ধক রেখে ঋণ। এর ভুক্তভোগী হয়েছেন সাধারণ শেয়ার হোল্ডাররা। এসব ভুয়া ঋণের কারণে ২০১৬ সালে যেখানে ব্যাংকটির প্রভিশন ছিল মাত্র ৭০ কোটি টাকা, ২০১৭ সালের ৯ মাসে সেই প্রভিশনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকা। রেজাউল হক নিজের লুটপাটে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত লুটপাট করেছেন অবাধে। প্রতি বছর ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট ছাপানো বাবদ মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোটি টাকার ওপর লুট করেছেন। চলতি বছর ব্যাংকের টাকায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি কিনেছেন। জানা গেছে, এসআইবিএলের এসব অযাচিত ব্যয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ থেকে একাধিকবার প্রশ্ন করা হয়েছে। কয়েকবার শোকজও করেছে ব্যাংকটিকে। তবে রেজাউল হকের প্রভাবের কারণে কিছুই হয়নি। এ ছাড়া সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন থেকে এই ব্যাংকটির বিরুদ্ধে অনিয়মের কারণে শোকজ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন যেভাবে ব্যাংক চলেছে তাতে একটি পরিবর্তন দরকার ছিল। ব্যাংকটিকে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিকবার সতর্ক করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে।

সর্বশেষ খবর