সোমবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

গণপরিবহনশূন্য রাজধানী

নিজস্ব প্রতিবেদক

গণপরিবহনশূন্য রাজধানী

ব্যস্ত মতিঝিল শাপলা চত্বর গতকাল গাড়িশূন্য —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে পরিবহন সংকটে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল রাজধানী ঢাকা। সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে গতকাল সকাল থেকেই যানবাহন না পেয়ে অফিস-আদালত এবং স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। সকাল থেকে বেলা ২টা নাগাদ রাজধানী থেকে কোনো ধরনের দূরপাল্লার বাস না ছাড়ায় সারা দেশ থেকে রাজধানী কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এ সময়ের মধ্যে রাজধানীতে কোনো দূরপাল্লার পরিবহনও প্রবেশ করেনি। সিটি সার্ভিসের শত শত বাস রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পার্কিংরত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী গাজীপুর, সাভার, সোনারগাঁও, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদীসহ স্বল্প দূরত্বের এলাকাগুলো থেকে যাত্রীবাহী বাস চলাচল সকাল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেকের অভিযোগ, পরিবহন মালিকরা ইচ্ছা করেই এমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। বিএনপি অভিযোগ করেছে, তাদের সমাবেশে জনসমাগম ঠেকাতে পুলিশসহ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বাস চলতে দেননি। তবে বাস মালিক সমিতির নেতা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেছেন, বিএনপির কর্মসূচিতে জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয় থেকে অনেক মালিক বাস নামাননি। বিকালের পর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, নিরাপত্তার আশঙ্কায় গাবতলী, সায়েদাবাদ, মহাখালী থেকে দূরপাল্লার বাস ছাড়া হয়নি। একই সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখগুলোতে চরম যানজটও এর অন্যতম কারণ।

দুর্ভোগে পড়া যাত্রীরা জানান, সিএনজি অটোরিকশা, হলুদ ট্যাক্সি ক্যাব ও ভাড়ায় চালিত উবারের গাড়ি ছিল যেন ‘সোনার হরিণ’। কোনো রিকশা, অটোরিকশা এলেই যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। তবে অন্যসব দিনের চেয়ে রিকশা কিংবা অটোরিকশার চালকরা হাঁকিয়েছেন তিন থেকে চারগুণ ভাড়া। গতকাল বিএনপির সমাবেশে এসেছিলেন হবিগঞ্জের ইকবাল হোসেন নিপ্পন ও সালাউদ্দীন আহমেদ সালেক। তারা জানালেন, ভ্যান, অটোরিকশা, লোকাল বাসে চড়ে অনেক কষ্টে ঢাকায় এসেছেন। তাদের মতো আরও অনেকে এভাবে সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন। সরকার পূর্বপরিকল্পিতভাবে গণপরিবহন সমস্যা সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ তাদের। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন দেখা  গেছে, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত শাহবাগে ছিল অসংখ্য মানুষ। তীর্থের কাকের মতো তারা অপেক্ষা করছিলেন বাসের জন্য। ৩০ মিনিট পর একটি লোকাল বাস এলে তাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন যাত্রীরা। অনেকে ব্যর্থ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। আবার অনেকে হেঁটে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। গুলিস্তান থেকে ঢাকার নিকটবর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর কিংবা নরসিংদীতে কোনো ধরনের বাস ছেড়ে যায়নি। এসব জেলা থেকে কোনো ধরনের গণপরিবহনও রাজধানীতে প্রবেশ করেনি। নাশকতার আশঙ্কায় বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় বলে ওইসব জেলার বাস মালিকরা জানান। রবিবার সকালে ওইসব জেলা থেকে ঢাকাগামী দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি। এদিকে হঠাৎ করে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা। দুপুর ১২টা থেকে মতিঝিল-পল্টনমুখী সড়কে বিজয় সরণি ক্রসিং, খামারবাড়ী, বাংলামোটর, মগবাজার, পরীবাগ, সাকুরার গলি, সবজি বাগান ক্রসিং, মিন্টো রোডের পূর্বপাশ, অফিসার্স ক্লাব, কাকরাইল চার্চ, শিল্পকলার গলি, দুদকের গলি, কার্পেট গলি, মত্স্য ভবন পর্যন্ত ছিল গাড়ির সারি। মনে হচ্ছিল যেন গাড়িগুলো এসব সড়কে পার্ক করে রাখা হয়েছে। একই দৃশ্য ছিল উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, বনানী থেকে মহাখালী মগবাজার কিংবা কাকরাইলগামী রাস্তায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, বাস না ছাড়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা ছিল না। হয়তো ঢাকায় অস্বাভাবিক যানজটের কারণে দূরপাল্লার বাস মালিকরা তাদের বাস ছাড়েননি। তবে সিটি পরিবহনগুলো ঢাকার রাস্তায় অন্যসব দিনের মতোই চলাচল করেছে বলে দাবি করেন তিনি।

পথে পথে বাধা : বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

সাভার : বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীর প্রবেশদ্বার আমিনবাজার এলাকায় তল্লাশি চালানোর কারণে গতকাল ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ঢাকামুখী যানবাহনের দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে অনেককে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে যেতে দেখা গেছে। ঢাকা জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউজ্জামান বদি জানান, সমাবেশে যাওয়ার জন্য তিনি তার নেতা-কর্মীদের নিয়ে সকাল ১০টার দিকে সাভার থেকে রওনা দেন। সাড়ে ১০টার দিকে আমিনবাজার এলাকায় এলে সেখানে থাকা পুলিশের একটি চেকপোস্টে তাদের ১৩টি গাড়িবহর আটকে দেয়। নারায়ণগঞ্জ : কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী সব গণপরিবহন গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত বন্ধ ছিল। এতে সাধারণ মানুষ হেঁটে, ভ্যান গাড়িতে ও রিকশায় করে ঢাকায় যাতায়াত করেছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকাগামী বন্ধন, উৎসব, শীতল এসি বাস, হিমাচল, আনন্দ পরিবহনের অন্তত ৫০০ বাস চলাচল করেনি। পরিবহন মালিকদের দাবি, চালক ও হেলপার না আসায় এবং ঢাকার শনিরআখড়ায় গাড়ি আটকে দেওয়ায় গাড়ি বন্ধ ছিল। একই অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও হয়েছে। এদিকে কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে ট্রেন চলাচল করলেও নির্ধারিত সময় কোনো ট্রেন ছাড়েনি। সোনারগাঁ : সকাল থেকে মেঘনা ও মোগরাপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকামুখী বাস চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে কেউ হেঁটে, কেউ বিকল্প যানবাহনে গন্তব্যে যান। সোনারগাঁয়ে বিভিন্ন সড়ক ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। যাত্রীদের ধারণা, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির সমাবেশকে ঘিরেই গণপরিবহন বন্ধ করে দেন বাস মালিকরা। ময়মনসিংহ : ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী সব বাস সার্ভিস বন্ধ ছিল। এতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী যাত্রীরা দুপুর পর্যন্ত ভোগান্তি পোহান। বেলা ২টার পর ময়মনসিংহের মাসকান্দা ও ব্রিজ মোড় বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস চলাচল শুরু করে। গাজীপুর : গাজীপুরের বিএনপি নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ দিতে ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনে ঢাকায় গেছেন। এদিকে বিএনপির সমাবেশের আগের রাতে বিভিন্ন অভিযোগে ৩৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ। বিএনপির দাবি, আটককৃতদের মধ্যে অধিকাংশই তাদের দলীয় নেতা-কর্মী। এদিকে সকাল থেকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হিসেবে খ্যাত কালিয়াকৈরের চন্দ্রায় দেখা গেছে গণপরিবহনের স্বল্পতা। ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে সীমিত পরিসরে যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। অন্যান্য দিনের মতো গতকাল গণপরিবহনের বাড়তি চাপ দেখা যায়নি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর