সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

চিরনিদ্রায় শায়িত মেয়র আনিস

নিজস্ব প্রতিবেদক

চিরনিদ্রায় শায়িত মেয়র আনিস

শনিবার রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের জানাজায় সর্বস্তরের মানুষের ঢল —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গত শনিবার বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনায় ৬ ডিসেম্বর গুলশান আজাদ মসজিদে কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়রের মরদেহ লন্ডন থেকে দেশে আনা এবং বনানীতে দাফন করা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী রুবানা হক। এর আগে বনানীর এ ব্লকের ২৩ নম্বর সড়ক ও আর্মি স্টেডিয়ামে হাজার হাজার মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন। আনিসুল হক মানুষের অন্তরে বেঁচে থাকবেন বলে জানিয়েছেন তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাধারণ মানুষ। শনিবার বেলা ১টার দিকে আনিসুল হকের মরদেহ নিয়ে স্ত্রী রুবানা হক, ছেলে নাভিদুল হক, দুই মেয়ে ওয়ামিক উমায়রা ও তানিশা ফারিয়াম্যান হক বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখানে পরিবারের পক্ষে মরহুমের ভাই সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক মরদেহ গ্রহণ করেন। এ সময় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি শফিউল আলম মহিউদ্দিন, বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানসহ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১টা ২০ মিনিটে সেনাবাহিনীর পাহারায় অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ এসে বনানীর বাসায় পৌঁছায়। লাশ বহনকারী গাড়ির সঙ্গে প্রয়াতের বাড়িতে প্রবেশ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর এমপি, সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম রহমত উল্লাহ এমপি, সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান ও ব্যবসায়ী এ কে আজাদসহ ব্যবসায়ী সংগঠনের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিত্সাধীন মেয়র আনিসুল হকের বাবা শরিফুল হক অন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ছেলের লাশ দেখতে আসেন। এরপর স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালও যান আনিসুল হকের শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাতে। বেরিয়ে এসে জাফর ইকবাল সাংবাদিকদের বলেন, আনিসুল হক ঢাকা শহর নিয়ে যে স্বপ্ন দেখে গেছেন, কেউ না কেউ যেন তার স্বপ্নগুলো পূরণ করে তাকে শান্তি দেন। লাশ পৌঁছানোর আগে পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে যান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু ও জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ। লাশ পৌঁছানোর পরই উপস্থিত শোকাহত জনতা চোখের জলে প্রয়াত আনিসুল হককে শ্রদ্ধা জানান। বেলা ১টা ৫০ মিনিটে ২৩ নম্বর রোডের ৮০ নম্বর বাসায় এসে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি লাশের কাছে পৌঁছানোর পরই প্রয়াতের স্ত্রী রুবানা হক তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক ও আনিসুল হকের বড় ছেলে নাভিদুল হকসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। আনিসুল হকের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে তার রুহের মাগফিরাত কামনায় মোনাজাত করেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি প্রায় ২০ মিনিট অবস্থান করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছু সময় কথা বলেন এবং তাদের সমবেদনা জানান।  প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর ২৩ নম্বর রোডের দুই পাশে থাকা ব্যারিকেড খুলে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর বাড়ির মূল ফটকের সামনে ভিড় জমে অসংখ্য মানুষের। ফটকের পাশে আনিসুল হকের ছবি টানিয়ে শোকবই খোলা হয়। সেখানে শোক জানাতে আসা মানুষ একে একে স্বাক্ষর করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, বিএনপি নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ শত শত মানুষ আনিসুল হকের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানাতে সেখানে ছুটে যান। উপস্থিত সাংবাদিকদের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, একদিকে তার সততা ছিল, অন্যদিকে তার যোগ্যতা ছিল। যতদিন ঢাকা মহানগর থাকবে, ততদিন মানুষের স্মৃতিতে তিনি অক্ষয় হয়ে বিরাজ করবেন। আনিসুল হক ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও দক্ষ ব্যক্তি। তার এভাবে চলে যাওয়াটা কখনো পূরণ হওয়ার মতো নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ঢাকা সিটির দায়িত্ব পালনের জন্য দ্বিতীয় আনিসুল হক আর পাওয়া যাবে না। তিনি কত বড় মনের মানুষ ছিলেন, তা কথায় প্রকাশ করা যাবে না। বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, নির্দলীয় অবস্থান থেকে স্থানীয় সরকার যে চালানো যায়, উন্নয়ন করা যায়, সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন এবং সেই নজির রেখে গেছেন। এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, তিনি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবং দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন। এফবিসিআইর বর্তমান যে অবস্থান তা এই আনিসুল হক করে গেছেন। সবার প্রত্যাশা তার স্বপ্ন ও আদর্শ যেন চিরদিন থাকে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সাধারণত কথা বলি বলার জন্য। কিন্তু আনিসুল হক যা বলতেন, যে স্বপ্ন দেখতেন তা তিনি বাস্তবায়ন করতেন। এফবিসিসিআইর সভাপতি শফিউল আলম মহিউদ্দিন বলেন, আনিসুল হক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যতগুলো দায়িত্ব পালন করেছেন তার প্রতিটিতে তিনি সফল হয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ছিলেন শোকাহত। এ সংস্থার কর কর্মকর্তা ইমামা খানম কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, তিনি সিটি করপোরেশনকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দুর্নীতির অনেক গভীরে গিয়ে তা নির্মূল করেছেন। কেউই সে কথা পুরোপুরি জানত না। তিনি সব সময় স্বপ্ন দেখতেন সুশৃঙ্খল ও সুন্দর নগরী গড়ার। এর জন্য অনেক কাজও সম্পন্ন করেছেন। এখন সেই অবস্থান ধরে রাখাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ঢাকাকে সুন্দর নগরীতে পরিণত করার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম। প্রতিটি দিন তার সঙ্গে আমার কথা হতো। মাঝ পথে তার এই চলে যাওয়াটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। আমাদের সুন্দর জুটিটা ভেঙে গেল। বেলা সাড়ে ৩টায় আনিসুল হকের মরদেহ আর্মি স্টেডিয়ামে পৌঁছায়। চারটি ফটক দিয়ে হাজারো মানুষ সারিবদ্ধভাবে স্টেডিয়ামে প্রবেশ করেন। সেখানে সর্বস্তরের হাজারো মানুষ ফুল দিয়ে প্রিয় মেয়রকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সরোয়ার হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদিন, স্পিকার শিরীন শারমিনের পক্ষে ক্যাপ্টেন মোশতাক আহমেদ, আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের পক্ষে শ্রদ্ধা জানানো হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) শহীদুল হকসহ ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তারাও শ্রদ্ধা জানাতে যান। এ ছাড়া বিজিএমইএ, এফবিসিসিআই, বিকেএমইএসহ সর্বস্তরের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানান। বাদ আসর জানাজায় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার হাজারো মানুষের ঢল নামে। জানাজায় মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী নেতারা অংশ নেন। জানাজার আগে আনিসুল হকের বড় ছেলে নাভিদুল হক বলেন, আমার বাবা ছিলেন একজন শৌখিন মানুষ। তিনি সুখী ও হাসি-খুশি মানুষ ছিলেন। আপনারা উপস্থিত হয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়েছেন, এটা অনেক পাওয়া। আমি দেশবাসীর কাছে বাবার জন্য দোয়া চাই। তিনি কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতেন না। ব্যক্তিগত স্বার্থে তিনি কাউকে দুঃখ দেননি। কাজের খাতিরে কেউ যদি আমার বাবার ব্যবহারে দুঃখ পেয়ে থাকেন, তাহলে আপনারা তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কেউ কোনো কিছু পাওনা থাকলে আমাদের পরিবার ও আমার চাচাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। স্টেডিয়াম থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় বনানীর কবরস্থানে। সেখানে মা রওশন আরা হকের পাশে ও ছোট ছেলে শারাফের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন আনিসুল হক। বিকাল ৫টা ১২ মিনিটে তার দাফন সম্পন্ন হয়। গত ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে যান মেয়র আনিসুল হক। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে গত ১৩ আগস্ট তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার শরীরে মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ ‘সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস’ শনাক্ত করেন চিকিত্সকরা। এরপর তাকে দীর্ঘদিন আইসিইউতে রেখে চিকিত্সা দেওয়া হয়। একপর্যায়ে মেয়রের শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় তার কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র খুলে নেওয়া হয়। মঙ্গলবার রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়লে তাকে আবার আইসিইউতে নেওয়া হয়। এরপর তার ফুসফুসও আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে মারা যান মেয়র আনিসুল হক। ব্যবসায়ী ও এক সময়ের জনপ্রিয় টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব আনিসুল হক ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালে নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তবে তার শৈশবের একটি বড় সময় কাটে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার নানার বাড়িতে।

সর্বশেষ খবর