সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

পোপ ফিরে গেলেন ব্যাখ্যা দিলেন ‘রোহিঙ্গা’ না বলার

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

পোপ ফিরে গেলেন ব্যাখ্যা দিলেন ‘রোহিঙ্গা’ না বলার

মিয়ানমার সফরে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এড়িয়ে গেলেও তার উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে বলে মনে করছেন খ্রিস্টান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। তিনি জানিয়েছেন, আলোচনার পথ বন্ধ করে না দিয়ে মিয়ানমার সরকার ও সামরিক বাহিনীর কাছে আসল বার্তাটি ঠিকই পৌঁছে দিতে পেরেছেন। তিন দিনের সফর শেষে শনিবার রোমের পথে ঢাকা ত্যাগ করেন পোপ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সফর শেষে বাংলাদেশ ঘুরে যান পোপ। পোপের সফরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরেক দফায় উজ্জ্বল হয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের কূটনীতিকরা। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ যে সত্যি একটি সহনশীল ও মানবতাবাদী দেশ, পোপের সফরে আরেক দফায় তা পুনঃপ্রকাশিত হলো। তার উপস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল হয়েছে। সেই সঙ্গে মিয়ানমারে সে দেশের সেনাপ্রধানসহ অন্য নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে তিনি যে ধরনের কথাবার্তা বলেছেন, তাতেও তাদের ওপর একটা চাপ অবশ্যই তৈরি হয়েছে। পররাষ্ট্র দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকায় আসার পর পোপ বিভিন্ন বক্তৃতায় মিয়ানমারের নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বিশ্ববাসীকে আহ্বান জানান, এ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের তিনটি পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে সাক্ষাৎ দেন পোপ। তাদের দুর্দশার কথা নিজ কানে শুনে আবেগময় হয়ে পড়েন তিনি। রোহিঙ্গা সংকটে পোপের এই বার্তা ও অবস্থানকে নিজেদের পক্ষে অর্জন হিসেবেই দেখছে বাংলাদেশ সরকার। বার্তা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সময় শরণার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে এবং তাদের দুর্দশা লাঘবে সরব হওয়া পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গাদের বিষয়েও তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরবেন বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রত্যাশা ছিল। মিয়ানমারে দেওয়া ভাষণে পোপ সম্প্রীতির ডাক দিয়ে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে সম্মান দেখানোর আহ্বান জানালেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ উচ্চারণ না করায় বিষয়টি সংবাদের শিরোনাম হয়। অবশ্য বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ মিয়ানমার রোমান ক্যাথলিক চার্চ সফরের আগেই পোপকে অনুরোধ জানিয়েছিল, তিনি যেন তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার না করেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, পোপের মুখ থেকে ওই শব্দটি এলে মিয়ানমারের খ্রিস্টান ও অন্য সংখ্যালঘুদের ওপর নতুন করে সহিংসতা শুরু হতে পারে। ঢাকা থেকে রোম ফেরার সময় উড়োজাহাজে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের কাছে মিয়ানমারে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করার ব্যাখ্যা দেন পোপ। মিয়ানমারের সেনানেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর বিষয়টি দৃঢ়তার সঙ্গেই তুলে ধরেছেন বলেও জানান রোমান ক্যাথলিকদের এই সর্বোচ্চ ধর্মগুরু। রোমের পথে পোপ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম। রাগে গড়গড় করছিলাম। আমি পাপী। আমি বারবার বলেছি তাদের অধিকারকে সম্মান জানানোর জন্য। তবে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হলো, বার্তাটা ঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া, একবারে একটি বিষয়ে কথা বলা এবং অন্য পক্ষের জবাব শোনা। আমি যদি বক্তৃতায় ওই শব্দটি ব্যবহার করতাম, তারা হয়তো আলোচনার পথ আমার মুখের ওপরই বন্ধ করে দিত। প্রকাশ্যে বক্তৃতায় আমি পরিস্থিতিটা তুলে ধরেছি, অধিকারের বিষয়গুলো সামনে এনেছি। বলেছি, নাগরিকত্বের অধিকার থেকে কাউকেই বঞ্চিত করা উচিত নয়। এটা করতে হয়েছে, যাতে একান্ত বৈঠকে আমি আরও কিছু বলতে পারি।’ ২৮ নভেম্বর ইয়াঙ্গুনে পৌঁছানোর পরপরই মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় পোপ ফ্রান্সিসের। ওই বৈঠকের বিষয়ে পোপ সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার ‘ভালো’ আলোচনা হয়েছে এবং সত্য প্রকাশে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন কি না—এ প্রশ্নে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ‘যে বার্তা আমি দিতে চেয়েছি সে জন্য প্রয়োজনীয় শব্দই আমি ব্যবহার করেছি। যখন বুঝলাম, আমার বার্তা তাদের কাছে পৌঁছেছে, তখন আমার যা যা বলার ছিল সবকিছুই বলার সাহস পেলাম।’ এরপর ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে এক সাংবাদিককে সেই লাতিন প্রবাদটি বলেন পোপ, যার অর্থ—বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। রোহিঙ্গা নিপীড়ন বন্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির প্রবল সমালোচনার মুখে পড়লেও পোপ বিষয়টি সেভাবে দেখছেন না। সু চির সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, রূপান্তরের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার রাজনৈতিকভাবে বিকাশের পর্যায়ে রয়েছে। সুতরাং সেই চোখ দিয়েই বিষয়গুলো দেখতে হবে। রাষ্ট্র গঠনের কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখেই এগোতে হবে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকায় রোহিঙ্গাদের তিনটি পরিবারের কাছ থেকে তাদের দুর্দশার কথা শুনতে শুনতে চোখ ভিজে আসার কথাও তিনি সাংবাদিকদের বলেন। তিনি জানান, সেই অশ্রু তিনি লুকাতে চেয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানেই পোপ এশিয়া সফরে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, ‘ঈশ্বরের উপস্থিতি রোহিঙ্গাদের মধ্যেও বিরাজ করছে।’

ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য নজির বাংলাদেশ : বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে বিশ্বের জন্য অনন্য নজির হিসেবে তুলে ধরেছেন পোপ ফ্রান্সিস। শনিবার সকালে সফরের শেষ দিন তেজগাঁওয়ে মাদার তেরেসা হাউসে যাজক ও ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে বক্তৃতায় বাংলাদেশের এ প্রশংসা করেন পোপ। মানুষে-মানুষে বিভেদকে ‘সমাজের খুঁত’ আখ্যায়িত করে পোপ বলেন, বাংলাদেশ হলো আন্তধর্ম ও ঐকতানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পোপ তার ভাষণে সবাইকে সমালোচনা ও পরনিন্দা থেকে দূরে থেকে আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকার মন্ত্র দিয়ে বলেন, ‘কারও সম্পর্কে নিন্দা করা একটি মানুষের একটি ত্রুটি। পেছনে কথা বলা সমাজের শান্তি বিঘ্নিত করে। পরনিন্দা করা এক ধরনের সন্ত্রাসবাদ। কারণ যেমন পরনিন্দা আড়ালে হয়ে থাকে, তেমনি সন্ত্রাসবাদও। কোনো মানুষকে অপছন্দের কথাটি যদি সম্ভব হয় মুখের সামনে বলে দাও, যদি তা না পারো তাহলে এ কাজে সহায়তা করতে পারে এমন শুধু একজনকে বলবে, আর কাউকে নয়।’ তিনি বলেন, ‘উদ্বিগ্নতা ও ভারাক্রান্ত মন থেকে অশুভ বীজই সৃষ্টি হয়। তাই নিজেকে সব সময় উত্ফুল্ল রাখবে। জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময়েও তোমাকে হাসতে হবে।’ এরপর নটর ডেম কলেজে প্রায় সাত হাজার তরুণের সামনে বক্তৃতায় পোপ আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহারের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো সমাজ কিংবা কোনো ধর্ম বলে তারাই সেরা, তখনই তাদের পতনের শুরু হয়। ‘আমি ভালো, তুমি মন্দ’ এটা বাদ দিয়ে সবাইকে ‘আমাদের’ ভাবতে হবে। নটর ডেম কলেজে তরুণদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার পর বিকালে শাহজালাল বিমানবন্দর হয়ে ফিরে যান পোপ ফ্রান্সিস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানান।

সর্বশেষ খবর