বুধবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজধানীতে ১১ মাদকরাজ্য

মোবাইল ফোনের অর্ডারে বাসাবাড়ি কিংবা আড্ডাস্থলে পৌঁছে যাচ্ছে মাদক

সাঈদুর রহমান রিমন

রাজধানীতে ১১ মাদকরাজ্য

রাজধানীর রামপুরা, খিলগাঁও, কমলাপুর, রূপনগর, কড়াইল, মহাখালী সাততলা বস্তি, আগারগাঁও, কালশী, টিটিপাড়াসহ ১১টি এলাকা মাদকের জোয়ারে ভাসছে। এসব মাদক স্পটে তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বেপরোয়া মাদক বাণিজ্য চলছে। কোনোভাবেই এ জায়গাগুলো মাদকমুক্ত করা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করেছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের, উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। এতেও সুফল মেলেনি। বরং সেসব মাদক স্পটে পেশাদার মাদক ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে এখন সোর্সরাই মাদক বাণিজ্য পরিচালনা করছে। একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার সরবরাহ করা মাদকই তারা বিক্রি করে বলে স্পটগুলো পুলিশের অভিযান থেকে মুক্ত থাকে। পুরনো মাদক স্পটগুলোর একেকটি মাদকের খোলামেলা আড়তে পরিণত হয়েছে। খিলগাঁও সি ব্লকে সিসি ক্যামেরা এবং শান্তিপুরে অ্যালার্ম সিস্টেম স্থাপন করেই চলছে মাদক কেনাবেচা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভিযানের আগেই মাদক ব্যবসায়ীরা তা সিসি ক্যামেরায় দেখে আগেভাগেই নিরাপদ স্থানে সটকে পড়ে। রাজধানীর রূপনগরের চলন্তিকা বস্তির পুরনো মাদক আখড়াটির নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘কমিশনার স্পট’। সেখানে ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের চারপাশ ঘিরেই চলে মাদকের অবাধ বেচাকেনা। চলন্তিকা বস্তিতে বছরের পর বছর ধরে চলে থাকা নজুর মাদক আখড়াটির নাম বদলে এ নাম রাখা হয়েছে। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা স্থানীয় এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজ্জব আলীর ছবি প্রিন্ট করে সমর্থক পরিষদের কার্ড বানিয়ে সেটাই আইডি কার্ড হিসেবে গলায় ঝুলিয়েছে। এ ব্যাপারে কাউন্সিলর রজ্জব আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রাজনীতি করার কারণে এসব বদনাম কিছু তো মেনে নিতেই হবে। সব কর্মী-সমর্থকের অপরাধ-অপকর্মের দায় তো আমি নিতে পারি না-আপনারা দেখেন, আমি মাদক বেচাকেনা করি কিনা। বনানীর কড়াইল বস্তি এলাকায় স্থায়ী স্পটের পরিবর্তে মোবাইল বিক্রেতা টিম গড়ে তুলেছে মাদক ব্যবসায়ীরা। এখন মোবাইলে পাওয়া অর্ডার অনুযায়ী বাসাবাড়ি কিংবা আড্ডাস্থলে মাদক পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। মাদকের পাইকারি চালান পরিবহনের ক্ষেত্রে মাদক ব্যবসায়ীরা একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যবহার করছে।

রেল থানা ঘিরে মাদক বাণিজ্য তুঙ্গে : কমলাপুর রেলওয়ে থানা ঘিরে সবচেয়ে বড় মাদক হাট বসে নিত্যদিন। জিআরপি ওসির কক্ষের ঠিক সামনেই ১৫-২০ ফুট পূর্ব পাশে রাতদিন চলে জমিলা-মানিকের ইয়াবা বাণিজ্য। দ্বিতীয় স্পটটিও থানার কাছেই ডোমঘরে (রেলে কাটা পড়া লাশ রাখার ঘর)। এ স্পটে সম্প্রতি মহানগর ডিবির অভিযান চলাকালে এসআই আলমগীরকে ছুরিকাহত করে পালিয়ে যায় ইয়াবার সেলসম্যানরা। এখানে গাঁজা, ইয়াবা ও ফেনসিডিল বিক্রি হয়। কমলাপুর রেলস্টেশনের তৃতীয় স্পটটি ৮ নম্বর প্লাটফর্মে। সেখানে গাঁজার সঙ্গে বিক্রি করা হয় হেরোইন ও ইয়াবা। চতুর্থ স্পটটি কমলাপুর রেলস্টেশনের কনটেইনার ডিপো এলাকায়। এখানে ফেনসিডিল ও প্যাথেডিন লুফিজিসিসহ ভারতীয় নেশার ইনজেকশন বিক্রি হয় অবাধে। পঞ্চম স্পটটি রেললাইনের ধারে কনটেইনার ডিপোর দক্ষিণ পাশে টিটিপাড়া মেথরপট্টি নামেই পরিচিত। এখানে বিক্রি হয় গাঁজা, ইয়াবা, বিয়ার ও মদ।

কমলাপুর রেলস্টেশনের মাদক স্পটগুলো একটানা তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে পরিচালনা করে কোটিপতি বনেছে জমিলার পরিবার। এক সময় মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় জমিলা স্বামী মোবারককে নিয়ে রেলস্টেশনের খোলা মাঠে আশ্রয় নিয়েছিলেন— আজ তার গাড়ি, বাড়ি, প্লট আর চাকচিক্যময় জীবন। জমিলার মতোই পুরনো মাদক ব্যবসায়ী হচ্ছেন সাজু মাতব্বর। কমলাপুর-মুগদা এলাকায় টানা ৩৭ বছর মাদক ব্যবসায়ী সাজু মাতব্বরের স্পটে প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ টাকার গাঁজা কেনাবেচা চলে। সাজু বলেন, নিজের ছেলেই নষ্ট করছে ব্যবসার ‘গুডউইল!’ তার ছেলে রজ্জব আলী গাঁজা বিক্রির টাকায় ইয়াবা সেবন করে, গাঁজা ক্রেতাদের মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। এসব কারণে নাকি সাজুর ব্যবসার গুডউইল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ষাটোর্ধ্ব সুঠামদেহী সাজু মাতব্বর স্মৃতিচারণ করে জানান, ১৯৮০ সাল থেকে গাঁজা বাণিজ্য শুরুর পর ৭০-৭২ বার গ্রেফতার হয়েছেন তিনি। মামলা খেয়েছেন ৮০টিরও বেশি। গাঁজা বিক্রেতা হয়েও অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অভিযানেই কমবেশি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তবে ওয়ান-ইলেভেনের সময় সেনা সদস্যদের নির্যাতন আর দুই দফা র‌্যাবের অত্যাচার ভুলতে পারেন না সাজু। তিনি বলেন, ‘সে ব্যথা কেউ দেখে না। সবাই শুধু সাজুর লাখ টাকা লাভ দেখে, চাঁদার রেট বসায়।’ সাজু মাতব্বরের হিসাব অনুযায়ী গত ৩৭ বছরে অসংখ্য  অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার কাছ থেকেই অন্তত পাঁচ কোটি টাকার গাঁজা উদ্ধার করেছে। উল্লিখিত সময়ে পুলিশ, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে তিনি মাসোয়ারা দিয়েছেন কমপক্ষে তিন কোটি টাকা। কমলাপুরের ৮ নম্বর গেট এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে পিচ্চি কামাল এবং স্টেশনের প্রবেশদ্বার ও এস আলম কোচ কাউন্টার সংলগ্ন মাদক স্পটটি চালায় মান্নান। এ ছাড়াও স্টেশন এলাকায় ফোনে অর্ডার নিয়ে ফ্লাটফর্মের ভিতরে ও ছয়তলা ভবনের পেছনের বাগানে ইয়াবা বিক্রি করেন পেয়ার নামে এক যুবক। শুধু কমলাপুর স্টেশনেই নয়, বরং কমলাপুর থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন পর্যন্ত রেললাইনের ডানে-বামে ২০টিরও বেশি মাদক আখড়া গজিয়ে উঠেছে। জিআরপি থানার পুলিশকে নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে এসব মাদক স্পট বহাল রাখা হয়।

খিলগাঁওয়ে মাদকবিরোধীরা বাড়িছাড়া : খিলগাঁওয়ে মাদক ব্যবসায়ী আর মাসোয়ারা পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা সিন্ডিকেট গড়ে মাদকবিরোধী আন্দোলনকারীদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মাদকবিরোধী র‌্যালি ও মিছিলে অংশ নেওয়াদের বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা মামলা দায়ের, হামলা চালিয়ে আহত করা ও পুলিশের হুমকি-ধমকি চলছে সমানতালে। এর মধ্যেই আন্দোলনের মূল নেতা আবদুল আজিজকে পুলিশ আটক করে আরেক মাদক ব্যবসায়ীকে বাদী সাজিয়ে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলায় জেলে পাঠায়। মাদকবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা স্থানীয় সাংবাদিক সুজন শেখকেও আটক করে পুলিশ। এ ছাড়াও মাদকবিরোধী মানববন্ধনে অংশ নেওয়া খিলগাঁও সি ব্লকের মাইনুল হাসান, সিপাহিবাগের সোহেল হাওলাদার, মামুন হাওলাদার, মেরাদিয়ার শুভ, মো. কবির, জহিরুল ইসলাম সাফিন, মোহর আলী, মনির হোসেন, রাসেল, সাকিল অব্যাহত হুমকি-ধমকি ও হামলায় আহত হয়ে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মাদকবিরোধী মিছিলে অংশ নেওয়া তিলপাপাড়ার শাহীন, আবদুর রহমান, গোড়ানের চঞ্চল, আলী হোসেন, মোমিন খানসহ খিলগাঁও এলাকার অনেকের বাড়িতেও পুলিশ নিয়মিত হানা দিচ্ছে। ডিবি ও পুলিশ টিমের সঙ্গে থাকা মাদক ব্যবসায়ী রাজিব, ফর্মা হুমায়ুন, শুক্কুরসহ কয়েকজন প্রকাশ্যেই হুমকি দিচ্ছে, মাদক নিয়ে আন্দোলনের শখ মিটিয়ে দেওয়া হবে। ফলে এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। ফলে মাদকবিরোধী আন্দোলনরত লোকজন খিলগাঁও ছেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সব মাদক ব্যবসায়ী পুনরায় খিলগাঁও এলাকায় ঢুকে বুক ফুলিয়ে চলছে এবং সেখানে আবারও মাদক বাণিজ্য অবাধে চলছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর