বুধবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
মানবাধিকার কাউন্সিলের জরুরি অধিবেশন

মিয়ানমারে গণহত্যার আশঙ্কা জাতিসংঘের

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে সেখানে ‘গণহত্যার আশঙ্কা’ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের হাইকমিশনার জেইদ আল রাদ আল হুসেইন। গতকাল জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের এক জরুরি অধিবেশনে তিনি এ আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এই প্রথম জাতিসংঘের কারও মুখে আরাকানে ‘গণহত্যা’ শব্দটি শোনা গেল। এর আগে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তি একে গণহত্যা বললেও জাতিসংঘ একে জাতিগত নিধন বলে আসছিল।

 কাউন্সিলের এই অধিবেশনের প্রথম অংশে উন্মুক্তভাবে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করে সদস্য রাষ্ট্রগুলো। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কাউন্সিলকে বলা হয়, এই সংকট আর কোনোভাবেই দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। অধিবেশনের প্রথম অংশে উন্মুক্ত আলোচনা শেষে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের প্রস্তাবে ‘মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীষর্ক এই বিশেষ অধিবেশনের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের এই প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ মোট ৩৩টি সদস্য রাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ ৪২টি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র। উন্মুক্ত আলোচনায় গ্রুপ অব ফ্রেন্ডস অন রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্টের পক্ষে যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডস, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পক্ষে এস্তোনিয়া, ওআইসির পক্ষে পাকিস্তান, নরডিক দেশগুলোর পক্ষে ডেনমার্ক, আরব দেশগুলোর পক্ষে ওমান এবং একক রাষ্ট্র হিসেবে চীন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ বক্তব্য উপস্থাপন করে। দ্বিতীয় অধিবেশন শেষে খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ করার কথা রয়েছে কাউন্সিলের। বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অধিবেশনের দ্বিতীয় সেশন চলছিল। অধিবেশনের প্রথম সেশনে হাইকমিশনার জেইদ রাদ আল আল হুসেইন বলেছেন, ‘চলতি বছরের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত ৬ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক আছে। তবে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। তাদের মুখ থেকে শোনা গেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ, গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার বর্ণনা। তাদের মুখে এসব ঘটনার বিবরণে এতটাই মিল যে, সেখানে যে গণহত্যা চলেছে সে সম্ভাবনা আর উড়িয়ে দেওয়া চলে না। আমরা যদি রোহিঙ্গাদের স্বতন্ত্র নৃতাত্ত্বিক, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সত্তার কথা ভাবী এবং যারা সহিংসতা ঘটাচ্ছে তাদের আলাদা সত্তার কথা মনে রাখি, তাহলে গণহত্যা যে ঘটে থাকতে পারে তা উড়িয়ে দেওয়া চলে না।’ আল হুসেইন আরও বলেছেন, মানবাধিকার পরিস্থিতির অব্যাহত নজরদারি এবং শরণার্থীদের নিরাপদে ও মর্যাদা নিয়ে বসবাসের পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তাদের কাউকে দেশে ফেরত পাঠানো উচিত হবে না— এটা দ্ব্যর্থহীনভাবে স্পষ্ট হতে হবে। উন্মুক্ত আলোচনায় চীনের প্রতিনিধি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে মিয়ানমারের পদক্ষেপকে সমর্থন করে বলেন, আলোচনাই এই সংকটের একমাত্র সমাধান। এ সময় চীনের পক্ষ থেকে আগে প্রস্তাবিত তিন স্তরের সমাধান প্রস্তাব পুনরায় উত্থাপন করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেওয়া পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অধিবেশনে কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘আমাদের কিছু বন্ধু বলেছে বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি আর দ্বিপক্ষীয় বিষয় নেই। আমরা বিষয়টি সব সময় দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছি কিন্তু মিয়ানমার বিশেষ করে ২০০৫ সালের পর থেকে কখনই আগ্রহ দেখায়নি। আমরা বিশ্বাস করি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার প্রয়োজন আছে।’ গত মাসে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটি সামগ্রিক সমাধানের একটি অংশ মাত্র। কাউন্সিলে মিয়ানমারের প্রতিনিধি বলেছেন, এই সহিংসতা মিয়ানমার সরকারের নীতি নয়, বরং চরমপন্থিরা এসব ঘটাচ্ছে এবং তাদের ঠেকাতে সরকার সবকিছুই করছে। তিনি যাই বলুন, আল হুসেইন বলেন, বৈষম্য ও সহিংসতা অব্যাহত থাকলে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিতভাবেই আরও দুর্ভোগের শিকার হতে হবে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের কর্মকর্তারা সাধারণত জেনোসাইড বা গণহত্যা শব্দটি হালকাভাবে ব্যবহার করেন না। জেইদ আল রাদ আল হুসেইন যে এই শব্দটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাতে বোঝা যায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সহিংসতায় জাতিসংঘ কতটা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। শুধু তাই নয়, এতে আরও স্পষ্ট হচ্ছে যে, এই সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনতে অং সান সু চির ব্যর্থতায়ও তারা হতাশ।

সর্বশেষ খবর