শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

বরিশাল দখলে নিয়ে বীরের বেশে প্রবেশ করি

ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, বীরউত্তম

বরিশাল দখলে নিয়ে বীরের বেশে প্রবেশ করি

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর আমরা ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল শহর দখল করে নেই। বন্দী করি পাঞ্জাবি অফিসার, রাজাকারসহ বেশকিছু পাকিস্তানি সৈন্যকে। এই বন্দীদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী যখন বীরের বেশে বরিশাল শহরে প্রবেশ করছিল, তখন রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করছিল সর্বস্তরের জনতা। বরিশাল সদর রোডের সেই দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিক পর্যন্ত পুরো রাস্তায় এমনভাবে ফুল ছিটানো হয়েছিল, এতে আমার জিপের চাকা এগোতে পারছিল না। এত ফুল আমি জীবনে দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যদি আমি কখনো বই লিখি তাহলে বইয়ের নাম দেব— ‘আমি ফুল দেখেছি’। ‘৭১ এর মার্চে আমি ছিলাম পাকিস্তানের খারিয়া ক্যান্টনমেন্টে। এ সময় দেখেছিলাম, ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাজার হাজার সৈন্যকে বিমানে অথবা জাহাজে করে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সৈন্যরা সঙ্গে টাকা-পয়সাও নিচ্ছিলেন। এ সময় আমাদের ইউনিটের কিছু অফিসার পোস্টিং নিয়ে ঢাকায় চলে যান। ঢাকায় থাকা আমার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবের চিঠির মাধ্যমে জানতে পারলাম, ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ দলমতনির্বিশেষে সব বাঙালির ওপর পাকিস্তানিরা হত্যা, গুম, অগ্নিসংযোগসহ নানাভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে। ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি অফিসারদের কড়া নজরে রাখা হচ্ছিল। এমনকি কে কোন সংবাদপত্র পড়ে, রেডিওতে কে কী শোনে তাও রিপোর্ট হয়ে যাচ্ছিল। তাই আমরা দেশের খবর ভালোভাবে নিতে পারছিলাম না। তারপরও কানাঘুষা শুনতে পারলাম, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ভাষণে বলেছেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপর ২৭ মার্চ বিবিসি রেডিও থেকে জানতে পারলাম, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে একদিন রাওয়ালপিন্ডি ও শেয়ালকোট থেকে কিছু কাজ নিয়ে বাঙালি দুই আর্মি অফিসার বন্ধু আমাদের ক্যান্টনমেন্টে এলেন। তিন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, বাংলাদেশে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে পাকিস্তানে আমাদের চাকরি করা ঠিক হবে না। কিন্তু কীভাবে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাব, বুঝতে পারছিলাম না। বাঙালি অফিসারদের ছুটিও দেওয়া হচ্ছিল না। আমরা বাঙালিরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরোতেও পারছিলাম না। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। সরকারি ছুটির দিন। এজন্য আমাদের কিছু সময়ের জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হলো। সেই সুযোগে আমরা তিন বন্ধু মিলে খাসিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে শিয়ালকোটে এলাম। শিয়ালকোট হলো ইন্ডিয়ান বর্ডারে পাকিস্তানের একটি শহর। এখানেও একটি ক্যান্টনমেন্ট আছে। এখানে এসে সন্ধ্যার পর আমরা তিনজন বর্ডার ক্রস করতে রওনা হই। পরদিন ভোরে আমরা ইন্ডিয়ান কাশ্মীরে প্রবেশ করি। সেখানে কয়েকজন ইন্ডিয়ানের সঙ্গে আমাদের দেখা হলো। তাদের বললাম, আমরা পাকিস্তানের আর্মি অফিসার। আমরা বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। আমাদের সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দিতে পারেন? এ কথা শুনে ওই লোকেরা জম্মু ক্যান্টনমেন্টে খবর দিল। খবর পেয়ে সেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি এলো। সন্ধ্যায় ওই ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমাদের পাঠানো হলো পাঠানকোট। এরপর সেখান থেকে পাঠানো হলো দিল্লি। আমরা এক পোশাকেই পাকিস্তান ত্যাগ করেছিলাম। এরপর আমাদের বিমানে কলকাতায় পাঠানো হলো। সেখানে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের হেড কোয়ার্টার। কর্নেল ওসমানীর হেড কোয়ার্টারও ছিল এখানে। ওসমানীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তিনি ৯ নম্বর সেক্টরে পোস্টিং দিলেন। এ সেক্টর ছিল সাতক্ষীরার হাসনাবাদ, টাকিনগর বলে এক জায়গায়। সেক্টর কমান্ডার হলেন মেজর জলিল। ২১ আগস্ট আমি সেক্টরে এলাম। মেজর জলিল আমাকে পেয়ে খুশি হলেন। আমাকে তিনি বরিশালের অভ্যন্তরে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন। ২৬ আগস্ট ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি পশ্চিম বাংলার বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে প্রবেশ করি। যশোর থেকে কালিগঞ্জ, তাহেরপুর, টুঙ্গিপাড়া ও পয়সারহাট হয়ে আমি উজিরপুর এসে ক্যাম্প গঠন করি। আমাদের পেয়ে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধারা সাহস পেলেন।  ২ সেপ্টেম্বর উজিরপুরের হার্তা এলাকায় পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর বিমান ও গানবোট হামলা করে। মুক্তিযুদ্ধে এখানে আমি প্রথম যুদ্ধ শুরু করি। মিলিটারি একাডেমি থেকে ট্রেনিং নিয়েছি সত্যি, কিন্তু কখনো বাস্তব যুদ্ধ করতে হয়নি। তাই এখানে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছিল, আমার ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে আসা কিছু সিনিয়র সৈনিক বললেন, স্যার ঘাবড়াবেন না। আপনি শুধু আমাদের পাশে থাকেন। তখন আমি পাকিস্তানের গানবোটগুলো লক্ষ্য করে রকেট লাঞ্চারের গোলা ছুড়তে থাকি। একটা গানবোট ওখানেই ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানে আমরা ছয়টি লঞ্চ ধ্বংস করতে সক্ষম হই। এ ছাড়া সেখানে অনেক পাঞ্জাবি ও রাজাকার মারা যায় এবং শত্রুপক্ষের অনেকেই আহত হয়। এতে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বেড়ে যায়। হার্তায় সফল অপারেশন সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে আমার একটার পর একটা অপারেশন। অবশেষে বিজয় ছিনিয়ে আনি আমরা। অনুলিখন : মাহমুদ আজহার

সর্বশেষ খবর