বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুজনে মিলে বিজয় দেখা হলো না

অধ্যাপিকা পান্না কায়সার

দুজনে মিলে বিজয় দেখা হলো না

একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর। সকাল থেকেই ফোন আসতে থাকে। আত্মীয়স্বজন সবার মুখে একটাই কথা— ‘দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, শহীদুল্লাহ কায়সার ফিরে আসবে।’ মনেপ্রাণে আমিও তা-ই বিশ্বাস করতাম। পরদিন ১৬ ডিসেম্বর, আনুষ্ঠানিক বিজয় এলো। সকাল ১০টার দিকে ছোড়দা (দেবর) বললেন, ‘ভাবী চলেন বড়দাকে খুঁজে আনি।’ মৃতপ্রায় মনটা তখন আনন্দে নেচে উঠল। তার মানে আমার স্বামী বেঁচে আছে। তখনো জানি না, কী বীভত্স খবর আমার জন্য অপেক্ষা করছে। সোজা চলে গেলাম জহুর হোসেন চৌধুরীর বাসায়। উনি বললেন, ‘যে অবস্থাতেই হোক তাকে পাওয়া যাবে। তুমি শক্ত হও, মা।’ তারপর ছোড়দাকে চোখের ইশারায় কী যেন বললেন। আমাকে নিয়ে ফের রিকশায় চড়লেন ছোড়দা। জানতে চাইলাম, ‘দাদা আমরা কোথায় যাচ্ছি।’ বললেন, ‘দেখি থানা-টানা খুঁজে দেখি।’ রিকশায় যেতে যেতে দেখলাম মা-বোনেরা বিজয়ের সাজে সেজেছেন কী সুন্দর। রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ফুল ছিটিয়ে বরণ করছেন। মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে উঠল। বার বার স্বামীর সেই কথাগুলোই কানে বাজতে লাগল। ‘ও’ বলেছিল, ‘দেশ স্বাধীন হলে তুমি খোঁপায় ফুল দেবে। লাল শাড়ি পরবে। আমরা দুজন মিলে বিজয় উল্লাস করব।’ কল্পনাকে দূরে ঠেলে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে এসে থামল আমাদের রিকশা। তারপর যা দেখলাম তা ভাষায় বর্ণনার নয়। তবে এটাও তো ঠিক যে, ওই দৃশ্য না দেখলে হয়তো আমার জীবনের বাঁক পরিবর্তন হতো না। দেখলাম অসংখ্য বিকৃত লাশ। ছিন্নভিন্ন নাড়িভুঁড়ি। কারও হাত-পা নেই। কারও মাথা কাটা। মা-বোনেরা পড়ে আছেন নিথর বিবস্ত্র। লাশের স্তূপে প্রিয়জনকে খুঁজছে মানুষ। অধিকাংশই কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসছেন। আমি ছিলাম বোধহীন। নির্বাক শিশুর মতো। দ্রুত স্যান্ডেলটা খুলে নিচে নেমে গেলাম। বেশ কয়েকটা লাশ উল্টে-পাল্টে দেখলাম। পাগলের মতো লাশের স্তূপে ‘ওর’ সুন্দর পা দুখানা খুঁজে পেতে হাতড়ে বেড়ালাম। সেই সুন্দর ঘনকালো চুল! ছোড়দা আমাকে টেনেহিঁচড়ে উপরে তুললেন। যা বোঝার বুঝে গেলাম। শেষবারের মতো লাশের স্তূপের দিকে তাকিয়ে আমার পৃথিবী বদলে গেল। ভিতরটাই কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। বোধের ভিতরে জ্বলে উঠল এক আগুন। মনের অজান্তে নিজেই নিজেকে বললাম, ‘আমি আছি, আমি থাকব।’ এরপর অসম্ভব এক বোধশক্তির উদয় হলো। চোখের পানি শুকিয়ে গেল। আমাদের ছয় মাসের ছেলে ও দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে শুরু হলো আমার জীবনের দ্বিতীয় যুদ্ধ। মাত্র একজন মানুষের অনুপস্থিতিতে জীবনের প্রতি পদে পদে টের পেলাম বাস্তবতা কী। যে বাস্তবতায় আমি আজও লড়াই করে চলেছি। যে লড়াইয়ের শুরুতেই পাশে পেয়েছি শহীদুল্লাহ কায়সারের অতি প্রিয় একজন মানুষ বঙ্গবন্ধুকে। ডিসেম্বরে আলবদর রাজাকাররা যে কিলিং মিশন শুরু করেছিল তা হয়তো শহীদুল্লাহ কায়সার জানত। কিন্তু আমাকে সে কখনই বুঝতে দিতে চায়নি। আমি ঠিকই বুঝতাম। ওকে বিমর্ষ দেখতাম। আবার ওর মধ্যে এক ধরনের তীব্র উত্তেজনাও দেখতাম। বিজয়ের উত্তেজনা। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলত, ‘তুমি স্বাধীনতা দেখেছ একটি, আর আমি দেখব দুটি।’ তখন ‘সংবাদ’ পত্রিকার জন্য সারাক্ষণ লেখালেখি করত। আর আমাকে পড়তে দিত। খবর এলো শহীদুল্লাহ কায়সারকে বাসা ছাড়তে হবে। তার জন্য অন্য একটি জায়গায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার শাশুড়ি সুফিয়া খাতুন শুনে বললেন, ‘বাবা আজই চলে যা।’ ‘ও’ বলল, ‘না, আমাকে তো কাল সময় দেওয়া হয়েছে। কালই যাব।’ আমি ব্যাগ গোছানোর কথা বলতেই বলল, ‘ব্যাগ-ট্যাগ লাগবে না, দেশ তো স্বাধীনই হয়ে গেছে।’ তবুও আমি ছোট্ট একটি ব্যাগ গুছিয়ে দিলাম। ১৩ ডিসেম্বর সকালে টলমল চোখে বিদায় নিল সে। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে আধা ঘণ্টার মধ্যেই আবার ফিরে এলো। আমরা জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘আমি ওখানে একা থাকব না। তোমাদের জন্যও জায়গা করা হয়েছে।’ শাশুড়িসহ আমরা সবাই রাগারাগি করলাম। বললাম, শত্রুরা তো আমাদের কিছু করতে আসবে না। ও বলল, ‘না ওদের বিশ্বাস করতে নেই। কাল তোমাদের সঙ্গে নিয়ে তবেই যাব।’ ওইদিন রাতের একটি ঘটনা আজও ভীষণ মন পোড়ায়, কষ্ট দেয়। রাতে সবাই মিলে খেলাম। ওকে দ্রুত ঘরে চলে যেতে দেখলাম। সব কিছু গুছিয়ে আমিও ঘরে গেলাম। দেখি টেবিলের ওপর সিগারেটের কাগজ। তার উল্টো পিঠে লেখা ‘প্রিয়তমাসু পান্না কায়সার, আমার ছেলে-মেয়েগুলোকে তুমি যত্নে রেখ। আমি জানি, তুমি পারবে। তুমি ভালো থেক। আমি কখনো কোথাও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাব না।’ আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। বললাম, কেন লিখলে! কী হয়েছে তোমার? কাল তো আমরা যাচ্ছিই। ‘ও’ বলল, ‘না, অনেক দিন প্রেমপত্র লিখি না তো, তাই লিখলাম।’ আমি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললাম। এখন ভীষণ কষ্ট হয়। আফসোস লাগে সেই শেষ লেখাটির জন্য। পরদিন ১৪ ডিসেম্বর। কারফিউ উঠল না। ভীষণ মন খারাপ হলো। অশুভ মনে হলো। বিকালে বারান্দায় দেখলাম, অনেক দূর থেকে দুই-তিনটা ছেলে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের বাসা দেখাচ্ছে। সন্দেহ হলো। মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে দেখলাম পাটিতে বসে শহীদুল্লাহ কায়সার কী যেন লিখছে। আমিও পাশে বসলাম। আমার পরনে ছিল সুন্দর একটা ভেলভেটের পাড়ের লাল শাড়ি। ‘ও’ বলল, ‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’ বললাম, রোমান্টিক কথা বাদ দাও। জরুরি কথা শোন। আমার সন্দেহের কথা জানালাম। চেহারায় চিন্তার ভাঁজ পড়লেও লুকিয়ে ফেলল। বলল, ‘ও কিছু না, হয়তো শহীদুল্লাহ কায়সারের বাড়ি দেখাচ্ছে।’ এসব নিয়ে কথা বলতে বলতেই ছোড়দা ছুটে এলেন। বললেন, ‘বড়দা, কে যেন আমাদের বাসার গেট ধাক্কাচ্ছে! খুলব?’ ও বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ খুলে দাও; মুক্তিযোদ্ধারা এসেছে।’ আমিও খুশি হলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের দেখব ভেবে। কিন্তু ছোড়দা নিচে নেমে আর আসে না। মুখে কালো কাপড় বাঁধা একদল লোক ঘরে ঢুকে বলল, শহীদুল্লাহ কায়সার কে। ও মাথা উঁচু করে বলল, ‘আমিই শহীদুল্লাহ কায়সার।’ সঙ্গে সঙ্গে তারা হাতটা ধরল। ঘরের লাইট বন্ধ ছিল। মোমবাতির আলোয় তাকে টেনে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গেল। আমি দৌড়ে গিয়ে ওর হাত ধরলাম। আমার চিত্কারে আমার ননদ ছুটে এলো। সেও ওর ভাইয়ের হাত টেনে ধরল। ওরা বন্দুকের নল দিয়ে ধাক্কিয়ে ওকে ফেলে দিল। আমি এক হাতে তাড়াতাড়ি করে লাইটের সুইচ অন করলাম। ওরা বলল, লাইট কেন দিলেন? বন্ধ করুন। আমি বললাম, আমার খুশি, এটা আমার বাড়ি। আমি ও আমার ননদ মিলে একজনের মুখের কালো কাপড় খুলতেও পারলাম। দেড় মিনিটের মধ্যেই এসব কিছু ঘটে গেল। ওরা আমাদের টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে দিল। নিয়ে গেল শহীদুল্লাহ কায়সারকে। শেষবারের মতো পেছন ফিরে আমার দিকে তাকাল ও। বলল, ‘ভালো থেক। আমি ফিরে আসব।’ বিজয় এলো। কিন্তু শহীদুল্লাহ কায়সার ফিরে এলো না। দুজন মিলে কত স্বপ্ন দেখেছি। রাত জেগে কত কবিতা পড়েছি। কবির ভাষায় বলেছি, ‘স্বাধীনতা, তোমাকে কবে বরণ করব?’ কিছুই হলো না আমার। দুজন মিলে বিজয় দেখব ভেবেছিলাম, বিজয় দেখা হলো না। তারপরও নতুন প্রজন্মকে বলি, ডিসেম্বরের এ বেদনা আমারই থাক। তোমরা এ বিজয়কে উদযাপন কর। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও শাণিত কর। দেশকে কীভাবে ভালোবাসতে হয় দেখিয়ে দাও। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বুঝিয়ে দাও দেশটা কী, কেন, কীভাবে হলো। সেই সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার যে সাহসী ভূমিকা পালন করে চলেছেন তাতে শামিল হও। যে যার জায়গা থেকে তাকে আরও শক্তিশালী হতে সহযোগিতা কর। আমরা তো তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছি। এই নতুন প্রজন্মের দিকে। তাই, বিজয় হোক তোমাদের। সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। অনুলিখন : জয়শ্রী ভাদুড়ী

সর্বশেষ খবর