শুক্রবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুদকের তৎপরতা বাড়লেও কমেছে মামলা চার্জশিট

মোস্তফা কাজল

দুদকের তৎপরতা বাড়লেও কমেছে মামলা চার্জশিট

২০১৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক)-এর তৎপরতা বেড়েছে আগের চেয়ে বহুগুণ। এই সময়ে দায়ের করা মামলায় আসামির সাজার হার বৃদ্ধিকে কমিশন তার সফলতা হিসেবেই দেখছে। তবে পুরো বছরে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা ও চার্জশিটের সংখ্যা কমেছে। কমিশন আস্থাহীনতার সংকট পুনরুদ্ধারে ফাঁদ পেতে ঘুষখোর ধরা, আসামি গ্রেফতার ও দুর্নীতির উৎস বন্ধে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সুপারিশ বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগ দিয়েছে। এসবের পাশাপাশি দুদক হটলাইন-১০৬-এর সেবা যাত্রা, দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও সর্বশেষ বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে নতুন গতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই সংস্থা সারা বছরই কম-বেশি আলোচনায় ছিল। দুর্নীতি দমনের চেয়ে উৎস খুঁজে প্রতিরোধ করার পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের ঔদ্ধত্যের বিষদাঁত ভেঙে জবাব দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে ২০১৭ শেষ করতে যাচ্ছে দুদক। এর আগে ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ দুদকের পঞ্চম চেয়ারম্যান হিসেবে ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব নিয়ে এরই মধ্যে অতিক্রম করেছেন দেড় বছরের বেশি সময়। বছরব্যাপী দুদকের কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কমিশন জনগণের আস্থা অর্জন ও প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করছে। আইন প্রয়োগে কুণ্ঠাবোধ করছে না। দুর্নীতিবাজদের ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এরা ব্যাংক লুট করা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষাব্যবস্থায় নানা সমস্যা তৈরি করছে। প্রজন্মের জন্য সবাই এক হয়ে দুর্নীতিবাজদের ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব দিতে হবে।

সাজার হার : চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত কমিশন ও ব্যুরোর আমলের মামলা মিলিয়ে সাজার হার দাঁড়িয়েছে ৫৮.৬৮ শতাংশ। তবে ব্যুরো আমলের চেয়ে কমিশন আমলে দায়ের করা মামলায় সাজার হার ছিল বেশি। কমিশনের দায়ের করা মামলায় সাজার হার ৬৪.৯৭ এবং ব্যুরোতে ৩৬.৪৩ শতাংশ। যেখানে ২০১৬ সালে সাজার হার ছিল প্রায় ৫২ শতাংশ। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ১৬৯টি মামলায় সাজা হয় এবং ১১৯টি মামলায় আসামিরা খালাস পায়। ২০১৭ সালে কমিশন ও ব্যুরো মিলিয়ে মোট ৩ হাজার ৪১৮টি মামলার বিচারকার্য শুরু হয়। আর চলমান ২ হাজার ৮৩১টি মামলার বিচার শুরু হয় এবং ৫৮৭টি মামলার বিচারকার্য উচ্চ আদালতে স্থগিত রয়েছে।

ফাঁদ মামলা : বিদায়ী ২০১৭ সালে দুদক ফাঁদের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আসামি গ্রেফতার হয়েছে। এক বছরে ফাঁদ পেতে সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তা পর্যায়ের ৩০ জনকে ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করে সংস্থাটির বিভিন্ন টিম। এর মধ্যে নৌপরিবহনের প্রধান প্রকৌশলী, শিক্ষা অফিসার, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন ভূমি কর্মকর্তা রয়েছেন। সব মিলিয়ে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় ২০১৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৭৮ জন আসামিকে গ্রেফতার করে দুদক। তবে এ বছর ২০১৬ সালের তুলনায় গ্রেফতারকৃত আসামির সংখ্যা অনেক কমেছে। ২০১৬ সালে দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল ৩৮৮ জন আসামি। বছরজুড়ে চলেছে দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দমনে শুদ্ধি অভিযান। অভিযানে একাধিক কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছে।

মামলা ও চার্জশিট : ২০১৬ সালের তুলনায় চলতি বছরে মামলা ও চার্জশিটের হার তুলনামূলক অনেক কমেছে। ২০১৬ সালের তুলনায় চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলা কমেছে ১০৩টি ও চার্জশিট কমেছে ১৩৭টি। চলতি বছরের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুদকে মামলা ও আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল হয়েছে যথাক্রমে ২২২টি ও ৩৫৪টি। যেখানে ওই একই সময়ে মামলা ও চার্জশিট দাখিল হয়েছে ৩২৫টি ও ৪৯১টি। মামলা ও চার্জশিটের সঙ্গে কমেছে আসামিদের অব্যাহতি। এ বছর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল (এফআরটি) বা আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে মোট ২২৫ মামলায়। যেখানে ২০১৬ সালে ৫০০টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালে ছিল ৫৯৮।

উৎস বন্ধে সুপারিশ : প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং বাণিজ্যসহ শিক্ষাব্যবস্থায় নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে এক বছর অনেকটা যুদ্ধ ঘোষণা করে দুদক। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক টিমসহ কয়েকটি টিম পৃথক অনুসন্ধান করে বেশকিছু দুর্নীতি ও অনিয়ম চিহ্নিত করে। একই স্কুলে ১০ থেকে ৩৩ বছর পর্যন্ত কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া। ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের যথাযথভাবে পাঠদান না করা এবং বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষকদের জড়িত থাকা, নোট বা গাইড, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণ, এমপিওভুক্তি ও নিয়োগসহ দুর্নীতির উৎস বন্ধে বিষয়ভিত্তিক ৩৯টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ গত ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদে পাঠিয়েছে দুদক।

হটলাইন সেবা : ‘যখনই দুর্নীতির ঘটনা, তখনই অভিযোগ’ এমন স্লোগানে গত ২৭ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে দুদক হটলাইন-১০৬। টোল ফ্রি এ অভিযোগকেন্দ্র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর অভিযোগকারীদের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে। গতকাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ লাখ ফোনকলে এসেছে বিভিন্ন অভিযোগ। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযোগ নিয়ে চলছে অনুসন্ধান। অভিযোগের ভিত্তিতে মাঝে মধ্যেই হচ্ছে অভিযান। সংস্থার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এতে দুদকের প্রতি আস্থা বাড়ছে। দুদক হটলাইন চালু ছাড়াও এক বছরে গ্রেফতার অভিযান জোরদার ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আসামি রাখতে দুদকে চলতি বছরে যোগ হয়েছে নিজস্ব হাজতখানা এবং ২০ সদস্যের সশস্ত্র ইউনিট।

বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি : বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, সিএজি কার্যালয় এবং সর্বশেষ আদালতের পর্যবেক্ষণের পর বছরের শেষ সময়ে নতুন করে আলোচিত বিষয় হচ্ছে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি। আদালতের নির্দেশনার পর ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এ ছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদকে। জিজ্ঞাসাবাদে বাচ্চুর স্বেচ্ছাচারিতা ও তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে নতুন তথ্য পেয়েছে দুদক। পাশাপাশি শুরু হয়েছে তাদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান। ফলে এবার প্রত্যাশা অনুযায়ী কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে পারবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া এ বিষয়ে নতুন আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়। এ নিয়ে মোট ৫৯টি মামলা দায়ের করেছে দুদক।

আলোচিত হাওর মামলা : সারা দেশে খাদ্য সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে হাওর অঞ্চল বলে খ্যাত সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ জেলাসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। কিন্তু নিম্নমানের কাজ ও সময়মতো সংস্কারের অভাবে চলতি বছরের এপ্রিলে ফসল রক্ষা বাঁধের ভাঙনে আকস্মিক বন্যায় আক্রান্ত হয় এই হাওর অঞ্চল। বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঠে নামে দুদক। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে গত ২ জুলাই হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে সুনামগঞ্জ জেলা পাউবোর ১৫ কর্মকর্তা এবং ৪৬ ঠিকাদার ও প্রতিষ্ঠানের কর্মীসহ ৬১ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে দুদক। এ ছাড়া পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ ১৩ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু বছরের শেষ সময়ে গত ১২ ডিসেম্বর হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির মামলায় তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেয় হাই কোর্ট।

অর্থ পাচারকারী : বছরের বিভিন্ন সময় ঘুরে ফিরে এসেছে বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে নানা সংবাদ। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রকাশিত তথ্যানুসারে ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা। যা দিয়ে বাংলাদেশের প্রায় দুই অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা সম্ভব। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পাচারকারীদের একটি বড় অংশের নাম বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। সেকেন্ড হোম, পানামা পেপারসের পর বছরের শেষ সময়ে সরব ছিল প্যারাডাইস পেপারসে ফাঁসকৃত বেশকিছু বাংলাদেশির নাম। সেকেন্ড হোম ও পানামা পেপারসে উঠে আসা বাংলাদেশিদের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করলেও এখনো দুদক রয়েছে অন্ধকারে। আলোচিত প্যারাডাইস পেপারসে ১০ জন বাংলাদেশির নাম রয়েছে।

সর্বশেষ খবর