রবিবার, ৭ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইয়াবা উন্মাদনা, আসক্ত ৩০ লাখ

নেশার গ্রাসে দেশ, মানসিক রোগী বাড়ছে

সাঈদুর রহমান রিমন

বানের পানির মতো দেশে ঢুকছে ইয়াবা। মিয়ানমারঘেঁষা কক্সবাজার-বান্দরবান সীমান্ত দিয়েই শুধু নয়, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেরও অন্তত ৪২টি পয়েন্ট গলিয়ে ঢুকছে ইয়াবা স্রোতের মতো। দেশের অভ্যন্তরেও গড়ে উঠেছে ইয়াবা-বাণিজ্যের সংগঠিত নেটওয়ার্ক। নিরাপদ-নির্বিঘ্ন এ নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর আসক্তি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন তা মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। অলিগলি, মোড়ে মোড়ে হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা। পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি, সিআইডি, আবগারিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব সংস্থার সদস্যরা রাত-দিন ইয়াবাবিরোধী অভিযানে থাকেন। প্রায় প্রতিদিনই হাজার হাজার পিস ইয়াবা জব্দ হয়। আটক হয় ইয়াবা পাচারকারী, বিক্রেতাসহ সেবনকারী। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবার স্রোত। শুধু বাংলাদেশে পাচারের জন্যই মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ৩৮টি ইয়াবা কারখানা। এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন ৩০ লাখেরও বেশি ইয়াবা টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্তের ২৩টি স্থান দিয়ে আসছে। গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় অভিবাসীদের কাছ থেকে এ তথ্য জানা গেছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারের মংডু থেকে বিভিন্ন ধরনের ফিশিং বোটের মাধ্যমে টেকনাফের স্থলবন্দর, শাহপরীর দ্বীপ, মাঝিরপাড়া, জালিয়াপাড়া, ট্রানজিট ঘাট, নাইট্যংপাড়া, সাবরাংয়ের লেজিপাড়া ও বার্মাপাড়া পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই দেশে লাখ লাখ পিস ইয়াবা আসছে। স্থানীয় সূত্রগুলো অভিযোগ করে জানায়, বিভিন্ন সংস্থার একশ্রেণির কর্মকর্তার সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সখ্য ও গোপন লেনদেন থাকায় ইয়াবার প্রবেশ কোনোভাবেই রোধ হচ্ছে না। স্থানীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে জানায়, টেকনাফের সাগরদ্বীপ, নয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, জেলেপাড়ায় প্রতি রাতে বসে ইয়াবার হাট। সেখানে মিয়ানমার থেকে আসা লাখ লাখ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটের পাইকারি বেচাকেনা চলে। ইয়াবা আমদানি ও তা দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করার ক্ষেত্রে বরাবরই কক্সবাজার এলাকার একজন এমপিকে ঘিরে যাবতীয় তদন্ত সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। কিন্তু ওই এমপির চেয়েও বেশি প্রভাব খাটানো প্রায় দুই ডজন রাঘব-বোয়াল এখন ইয়াবা আমদানি ও সরবরাহ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত সংস্থাগুলো ইয়াবার নব্য গডফাদারদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। তারা কক্সবাজার, টেকনাফ, বান্দরবান, টেকনাফের স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যোগসাজশে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশি অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী এখন স্থায়ী ডেরা তুলে অবস্থান করছেন মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে। সাগর ও নদীপথে আসা ইয়াবার একটি অংশ পাচার হয় টেকনাফ, হ্নীলা ও উখিয়ার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে। কড়া নজরদারির কারণে এখন সিংহভাগ চালান পাচার হয় সমুদ্রপথেই। চোরাচালানিরা দেশীয় ইঞ্জিনবোটযোগে লাখ লাখ পিস ইয়াবা নিয়ে গভীর সমুদ্রপথ ধরে সরাসরি হাতিয়া-সন্দ্বীপ, চরজব্বার এলাকায় পৌঁছে যাচ্ছে। সেখানে খালাস করা ইয়াবা স্থানীয় লঞ্চ-ট্রলারযোগে চাঁদপুর, শরীয়তপুর হয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকার পথে। কিছু চালান নৌপথে কুয়াকাটা ও ভোলা দিয়েও প্রবেশ করছে। বর্তমানে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে দক্ষিণের সীতাপাহাড়ে মিয়ানমারের ট্রলারের মাধ্যমে আসছে ইয়াবার বড় বড় চালান। সাগরপথে মাছধরার বড় ট্রলারে করে এসব চালান সেন্টমার্টিন থেকে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম হয়ে নারায়ণগঞ্জে আসে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেওয়া তথ্যমতে, কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে রয়েছে তালিকাভুক্ত ৭০০ ইয়াবা পাচারকারী। এর মধ্যে মহেশখালীর ৭, বান্দরবানের ১৫ জন ছাড়া বাকি পাচারকারী সবাই টেকনাফের বাসিন্দা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইয়াবার প্রেমে উন্মাদ : এখন দেশজুড়ে চলছে ইয়াবার বাজার। নতুন প্রজন্ম রীতিমতো ইয়াবার প্রেমে উন্মাদ। মাদকের বাজারে কেনাবেচার শীর্ষে রয়েছে সর্বগ্রাসী ইয়াবা। রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ইয়াবার অভিন্ন আস্তানা গজিয়ে উঠছে। মাদকটি আকারে ছোট হওয়ায় সহজে বহন করা যায়। এ কারণে অন্য মাদকের তুলনায় ইয়াবা সেবনকারী ও বিক্রেতারা খুব সহজে নিরাপদে সেবন ও বিক্রি করতে পারে। যারা ইয়াবা সেবন করে তারাই বিক্রির সঙ্গে জড়িত। আইনের চোখে ফাঁকি দেওয়ার জন্য সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাবা’। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় এটিকে নানা নামে ডাকা হয়। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, দিন দিন ইয়াবায় আসক্ত তরুণীর সংখ্যা বাড়ছে। খারাপ ও বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে বা মেয়েসন্তানদের মাধ্যমে অনেকেই এই জগতে প্রবেশ করছে। অনেকে আবার স্রেফ কৌতূহলের বশেও দু-একবার ইয়াবা সেবন করে স্থায়ীভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এদের অধিকাংশই স্কুল, কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ইয়াবার ভয়াবহতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল সব মহলকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রস্তুত করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, থাই ভাষায় ইয়াবা মানে ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ওষুধ। ইয়াবা এক ধরনের মাদক, যা হেরোইনের চেয়ে ভয়াবহ। এটি হেরোইনের বিকল্প হিসেবে ব্যবহূত হয়। ইয়াবার মূল উপাদান মেথ্যাম ফিটামিন এবং সঙ্গে থাকে উত্তেজক পদার্থ ক্যাফিন। ২৫ থেকে ৩৫ মিলিগ্রাম মেথ্যাম ফিটামিনের সঙ্গে ৪৫ থেকে ৬৫ মিলিগ্রাম ক্যাফিন মিশিয়ে তৈরি এ ট্যাবলেটের রং সাধারণত সবুজ বা লালচে কমলা হয়ে থাকে। নথিতে বলা হয়, ইয়াবা ট্যাবলেটের স্বাদ যে-কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে এবং সেবনের পর ধরা পড়ার আশঙ্কাও থাকে না। ইয়াবা ব্র্যান্ডের এসওয়াই, এনওয়াই ও ডব্লিউওয়াই নামের আরও তিনটি ট্যাবলেট বাজারে পাওয়া যায়। তবে রাজধানীতে এখন চার রকমের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে গাঢ় লাল রঙের ‘চম্পা’ প্রতি পিস খুচরা ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়। টেকনাফে এটি কেনা হয় ৩৫ থেকে ৫০ টাকায়। হালকা গোলাপি রঙের ‘আর সেভেন’ ইয়াবার দাম সবচেয়ে বেশি। এটি ঢাকায় কমপক্ষে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। হালকা গোলাপি রঙের আরেক ধরনের ইয়াবার নাম ‘জেপি’। এর খুচরা মূল্য ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ‘ডগ’ নামের মাটি রঙের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় প্রতিটি। এ ছাড়া বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে দেশেই তৈরি হচ্ছে আরেক ধরনের ভেজাল ইয়াবা। এগুলো ১০০ থেকে ১২০ টাকায় পাওয়া যায়। কেনাবেচা, সেবনে অভিজাত শ্রেণি এগিয়ে : সর্বগ্রাসী মাদক ইয়াবা কেনাবেচা ও সেবনের ক্ষেত্রে অভিজাত, ধনাঢ্যরাই এগিয়ে রয়েছেন। তারা যেমন ইয়াবা সেবনের নামে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা ধোঁয়ার মধ্যেই উড়িয়ে দিচ্ছেন, তেমনি ইয়াবা বাজারজাতও হচ্ছে তাদের হাত ঘুরেই। মাদক অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এলাকার লাগেজ পার্টির কয়েকজন সদস্য নিয়মিত থাইল্যান্ড যাওয়া-আসা করে এবং সেখান থেকে সরাসরি ইয়াবা নিয়ে আসে। কয়েকজন বিমানবালা তাদের সহযোগিতা করেন বলেও জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। মগবাজারের একটি রেকর্ডিং স্টুডিওর মালিকও ইয়াবার বড় ধরনের ডিলার হিসেবে চিহ্নিত। ‘শিল্পপতি’ বাবা-মার দামি গাড়িতে করে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় ইয়াবার বিপণন চলে হামেশা। কক্সবাজারের কলাতলীর হোটেল বে-ভিউ থেকে ইয়াবাসহ নায়িকা সিলভিয়া ওরফে চাঁদনীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় চলচ্চিত্র-প্রযোজক জি এম সরওয়ারসহ আরও চারজনকে আটক করা হয়। এর পরপরই ঢাকাই ফিল্মের আরেক পড়তি নায়িকা কেয়াকে বিপুলসংখ্যক ইয়াবাসহ গুলশানের একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আটক করে পুলিশ। এর আগে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগে গ্রেফতার হন চিত্রনায়িকা শানু, মডেল পায়েল ও রবি। জিজ্ঞাসাবাদে নায়িকা শানু জানান, গুলশান, বনানী, উত্তরাসহ অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলা হয় জলসাঘর। সেখানে ইয়াবা ব্যবসার পাশাপাশি চলে নানা অসামাজিক কার্যকলাপ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে ৩০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেফতার হন কলেজছাত্রী ম্যানিলা চৌধুরীসহ ছয়জন। ‘ছোট বড়ি’তে বড় ক্ষতি : জীবনীশক্তি ধ্বংসকারী ইয়াবা সেবনকারীরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। তারা যৌনশক্তি হারিয়ে ফেলছে চিরতরে। কিডনি-সংক্রান্ত নানা জটিলতায় ভুগছে তারা। বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিত্সাধীন ইয়াবা আসক্তদের ওপর পর্যবেক্ষণ করে চিকিত্সা বিশেষজ্ঞরা এসব তথ্য জানিয়েছেন। ইয়াবায় আসক্তদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘ছোট বড়ি’তে অনেক বড় ক্ষতির শিকার হচ্ছে তারা। ধলপুর, মানিকনগর ও মুগদাপাড়ার একাধিক ইয়াবাসেবী জানিয়েছেন, তারা একেকজন টানা ২০-২২ বছর ফেনসিডিল সেবন করেও সমাজে টিকে ছিলেন।  বিশ্ববিদ্যালয়ে হাত বাড়ালেই ‘বাবা’ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভয়াল থাবা বসিয়েছে মাদক বা বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। মাদকের ভয়াল থাবায় নিষ্পেষিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহজ-সরল শিক্ষার্থীর শিক্ষা কার্যক্রম। ধ্বংস হচ্ছে আগামী দিনের মেধাবীজীবন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্যাম্পাসে গাঁজা, তামাক, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, মদসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য অহরহ চালান হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান কতিপয় রাজনৈতিক নেতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। আসক্ত হচ্ছে তরুণীরা : আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, দিন দিন ইয়াবায় আসক্ত তরুণীর সংখ্যা বাড়ছে। বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে বা মেয়েসন্তানদের মাধ্যমে অনেকেই এ জগতে প্রবেশ করছে। অনেকে আবার স্রেফ কৌতূহলের বশে এক-দুবার ইয়াবা সেবন করে স্থায়ীভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ সুযোগে রাজধানী জুড়ে গড়ে উঠেছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অপ্রতিরোধ্য নেটওয়ার্ক।

সর্বশেষ খবর