ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের প্রতিবাদ সভা শুরু হবে। ওই সভায় যোগ দেবেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হক খান গালিব। তেজকুনিপাড়া সেকেন্ড লেনের বাসা থেকে বের হবেন তিনি। পরনে তার প্রিয় সাদা সার্ট ও কালো প্যান্ট। বুকে বাঁধা হোলস্টারে তার লাইসেন্স করা পিস্তল। ইতিমধ্যে গুলি লোড করে নিয়েছেন। এ একটি জিনিস তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। এটি কাছে থাকলে তিনি কাউকে পরোয়া করেন না। স্ত্রী শম্পার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বের হন। অভ্যাসবশত রাস্তায় বেরিয়েই তিনি দোতলার দিকে তাকালেন। বারান্দায় ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছেন শম্পা। হাত নাড়িয়ে আবারও বিদায় জানান গালিব। এটি তাদের অলিখিত নিয়ম। প্রতিবার বাসা থেকে বেরুনোর সময় এভাবেই হাত নেড়ে বিদায় নেন। গালিব দরজা থেকে বেরিয়েই বড় রাস্তার দিকে হাঁটা শুরু করেন। তিনি সব সময় একটু দ্রুত হাঁটতেন। সেদিন দ্রুত হাঁটতে গিয়ে কয়েক যুবককে দেখে গতি কমিয়ে দেন। কিন্তু যুবকরা ততক্ষণে তার সামনে চলে এসেছে। আসসালামু আলাইকুম গালিব ভাই। যুবকদের একজন সালাম দিয়েই নিজের কোমরে হাত ঢুকায়। গালিবের বুঝতে বাকি রইল না কিছু। যম হয়ে এসেছে তারা। মুহূর্তেই গালিবের হাত শার্টের কলারের কাছ দিয়ে চলে যায় বুকের বাম দিকে। ওখানেই তার সেই পছন্দের পিস্তলটি। কিন্তু বের করতে পারেননি। ততক্ষণে তার চারদিক ঘিরে থাকা যুবকদের অস্ত্র গর্জে উঠেছে। বাসার কাছে গুলিবিদ্ধ গালিব হুমড়ি খেয়ে পড়েন রাস্তার ওপর। ঠিক তখনই বড় রাস্তার কাছে আরও কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ। তারা হিটম্যানদের ব্যাকআপ দল। গুলির শব্দে রাস্তা ফাঁকা। সব হিটম্যান নিরাপদ। গাড়িতে চড়ে লাপাত্তা। রাস্তায় পড়ে থাকে সে সময়ের প্রচণ্ড প্রতাপশালী ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা গালিব। সাদা শার্ট রক্তে রঞ্জিত। লোকজন ছুটে আসে। গালিব গুলিবিদ্ধ হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। হতবাক সবাই। নিজ দল ক্ষমতায়। আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি অংশের নিয়ন্ত্রক গালিব বাসার সামনে গুলিবিদ্ধ হতে পারে বা কেউ তার ওপর হামলা করতে পারে, অবিশ্বাস্য যেন সবার কাছে। কিন্তু সে কাজটি হয়েছিল ২১ বছর আগে ১৯৯৭ সালের ২৭ মার্চ। আর দুঃসাহসিক এ কাজটি করেছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সেভেন স্টার বাহিনীর সুইডেন আসলাম। সুইডেন আসলাম এই খুনের আগে আরও বহু মানুষের রক্তে নিজের হাত রাঙ্গিয়েছিলেন। পুলিশ কখনো তার নাগাল পায়নি। কিন্তু এই এক খুনেই আসলামের জীবনে শুরু হয় নতুন অধ্যায়। গালিব খুনের পর আসলামের সাজানো সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে যায়। সেই সময় যে গ্রেফতার হয়েছিলেন আসলাম, এখনো কারাগারেই বন্দী হয়ে আছেন। আন্ডারওয়ার্ল্ডে সুইডেন আসলাম এখন শুধুই অতীত। এর পরেও তার নামে চাঁদা ওঠে কখনো কখনো। গালিব হত্যার ঘটনায় ওই দিনই তেজগাঁও থানায় মামলা করেন নিহতের স্ত্রী শাহেদা নাসরিন শম্পা। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ঘটনার দিন ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হলের সামনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের প্রতিবাদ সভা ছিল। গালিব তার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওই সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে তেজকুনিপাড়ার বাসা থেকে বের হন। স্বামীকে বিদায় দিয়ে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। বাদী তার মামলায় বলেন, ‘‘গালিব বের হওয়ার ২ মিনিট পরই ২/৩টি গুলির শব্দ পাই। ঘটনার পরপরই আমার বাসার সামনে দিয়ে ৮/১০ জন লোক পিস্তল ও ধারালো অস্ত্র হাতে দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমার ভাইকে পাঠাই গালিবের খোঁজ নেওয়ার জন্য। সে দ্রুত ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, দুষ্কৃতকারীরা দুলাভাইকে গুলি করেছে। মানুষ ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিচ্ছে।’’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মামলার আসামিরা হচ্ছেন— শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলামসহ ১৯ জন। কারাগারে আটক আছেন সুইডেন আসলাম, কুত্তাচোরা লিটন, শাহিন ও আরমান। এ চার আসামি ২১ বছর ধরেই কারাগারে আটক আছেন। এ মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামি শাহিন ১৯৯৭ সালের ২১ আগস্ট ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘‘গালিবের সঙ্গে কাওরানবাজারের হাটের টাকা নিয়ে লেংড়া মাসুদের তর্কাতর্কি হয়। গালিব কাউকে ভাগ না দিয়ে পাঁচ লাখ টাকাই নিয়ে যান। আসলাম ভাইয়ের কাছে এর বিচার আসে। আসলাম ভাই বলেন, ঠিক আছে এর কঠোর বিচার হবে।’’
শাহিন আরও বলেন, ‘‘আমরা সবাই আওলাদ মার্কেটে যাই। ওরা ভিতরে ঢোকে।দেলু ও মাসুদও ভিতরে ঢোকে। আমি ও আসলাম ভাই মেইন রোডে থাকি। দেলু ও মাসুদ গুলি করে। আসলাম ভাইও গুলি চালায়। আমিও গুলি চালাই। তবে আমার গুলি লাগেনি। গালিব পড়ে গেলে আমরা সবাই দৌড়ে পালাই।’’ এ মামলায় সুইডেন আসলামকে গ্রেফতার দেখানো হয় ১৯৯৭ সালের ২৯ মে। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান ডিবির পরিদর্শক এস এ নেওয়াজী। তিনি ঘটনাটি তদন্ত করে ১৯৯৯ সালের ৮ এপ্রিল ২০ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুল হক খান গালিব ঘটনার দিন ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত একটি সমাবেশে অংশগ্রহণের জন্য তার রাজধানীর ফার্মগেটের ৯৬, তেজকুনিপাড়ার নিজ বাসা থেকে বের হন। এরপর তেজকুনিপাড়ার ১০০ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাসার প্রধান গেটের সামনে রাস্তায় এলে সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই তিনি মারা যান। তবে ২১ বছরেও শেষ হয়নি মামলার বিচার। ফার্মগেট এলাকা একসময় নিয়ন্ত্রণ করতেন আজাদ-বাপ্পি নামে দুই ভাই। ১৯৮৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফার্মগেট নিউ স্টার হোটেল থেকে বাপ্পিকে জোর করে তুলে নিয়ে যান আসলাম ও তার লোকজন। মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে বাপ্পির ওপর চলে নির্মম নির্যাতন। একপর্যায়ে কোমল পানীয় ফান্টার একটি বোতল ভেঙে বাপ্পির শরীরে ঢুকিয়ে দেন আসলাম। রক্তাক্ত বাপ্পিকে চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে মিরপুরের দিকে ফেলে দিয়ে আসেন আসলামরা। এরপর এই আসলামের নাটকীয় উত্থান। যেন রূপকথার কোনো গল্প। যিনি ফান্টার ভাঙা বোতল দিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ড যাত্রা শুরু করেছিলেন, সেই আসলামই রাজত্ব করেছেন একে-৪৭সহ সব অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। লাশ ফেলতে শুরু করলেন। সুইডেন যেতেন। লাশ ফেলার প্রয়োজন হলে দেশে ফিরতেন। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল— এই ১০ বছর তার আধিপত্য বিস্তার ছিল আন্ডারওয়ার্ল্ডে ঈর্ষণীয়। গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিলেন। সুইডেন আসলামের এই নজিরবিহীন উত্থানে অস্থির হয়ে ওঠে গোটা আন্ডারওয়ার্ল্ড। যারা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড শাসন করেছিলেন, তারাও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন সুইডেন আসলামের এ অগ্রযাত্রায়। পুলিশের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। সোনা চোরাচালান থেকে শুরু করে রাজধানীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও কিলিং মিশনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন আসলাম। ঢাকার সাভার থেকে শ্যামপুর, টঙ্গী থেকে কেরানীগঞ্জ— এমন কোনো এলাকা ছিল না, যেখানে সুইডেন আসলামের ক্যাডার ছিল না। এমন একটি সময় ছিল যখন তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা তার নির্দেশ মতো জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। এমন এক পরিস্থিতিতে ১৯৯০ সালের মধ্যেই ঢাকার অন্যতম ডন হয়ে ওঠেন সেভেন স্টার গ্রুপের নেতৃত্বদানকারী সেই সুইডেন আসলাম। রাজাবাজারে শাকিল হত্যাকাণ্ড দিয়ে খুনি হিসেবে হাত পাকান সুইডেন আসলাম।
১৯৮৭ সালে শাকিল খুনের পর পুরান ঢাকার আগামাসি লেনে তিনজন খুন হন। মামুন, গোপাল কর এবং নুরুল ইসলাম নামে আন্ডারওয়ার্ল্ডের এই তিন যুবককে গুলি করে হত্যা করেন আসলাম ও তার সহযোগীরা। সুইডেন থাকতেই আসলামের সঙ্গে তার স্ত্রী ইতির দ্বন্দ্ব হয়। সুইডেন থেকে ইতি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে বিয়ে করেন আসলাম গ্রুপের মামুনকে। আসলাম সুইডেন থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন মামুনকে হত্যার জন্য। আগামাসি লেনে আগা শামীমের আস্তানায় মামুনকে সমঝোতার কথা বলে নেওয়া হয়। মামুন সেখানে যান ভারতীয় সন্ত্রাসী গোপাল কর ও গোপীবাগের নুরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সেখানে এই তিনজনকেই গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর আসলামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বিপুলকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। মামুনের সঙ্গে বিপুলের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এ কারণেই বিপুলকে তেজতুরী বাজারের একটি মাঠে নিয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। আসলাম একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে বিপুলের দুই হাত বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করেন। এরপর কলাবাগানে খুন করেন কিসলুকে। সর্বশেষ খুন করেন ঢাকার যুবলীগ নেতা গালিবকে। এই গালিব খুনের পরই ১৯৯৭ সালে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে আসলামের নাম ঘোষণা করে সরকার। তাকে গ্রেফতারে ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। এরপর তিনি গ্রেফতার হন।
এদিকে গালিবের উত্থান দ্রুতগতিতে। ’৯৪-এর শুরুতে কানাডার সিটিজেন গালিব ঢাকায় চলে আসে। এরপর তিনি ঢাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী গ্রুপ। সড়ক জনপথ দখল নিয়ে টেন্ডারের আধিপত্য নেন। ফাইভ স্টার গ্রুপের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফার্মগেট এলাকায় শুরু হয় আধিপত্য। সুইডেন আসলামের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তার সেখান থেকে। বড় বড় কাজ, ফুট ওভার ব্রিজের কাজ পান গালিব। চাঁদা দাবি করেন আসলাম। গালিব জানিয়ে দেন এক পয়সাও চাঁদা দেবেন না। মূলত এসব নিয়েই আসলাম তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটেন। বাস্তবায়ন করেন। যে অপারেশনে আসলাম নিজেও ছিলেন।