শুক্রবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা

বিচারক বললেন, পাঁচ বছর কী করেছেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

চাঞ্চল্যকর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আসামি পক্ষের এক আইনজীবীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছে আদালত। মামলার গ্রেফতারকৃত আসামি ও জঙ্গিনেতা মুফতি হান্নানের ছোট ভাই মুন্সি মুহিবুল্লা অভির আইনজীবী সাইফুর রশিদ সবুজ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য তুলে ধরায় আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে— ‘এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলা, এ ধরনের মামলায় লিখে লিখে আরগুমেন্ট হয় না। এ মামলায়ও যদি লিখে লিখে আরগুমেন্ট উপস্থাপন করতে হয় তাহলে পাঁচ বছর ধরে কী করলেন?’

গতকাল রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এসব কথা বলেন। এ সময় আদালত যুক্তিতর্কে আসামির জন্য প্রাসঙ্গিক হয়—এমন বক্তব্য ও আইনি পয়েন্টের আলোকে শুনানি করতে আইনজীবীকে পরামর্শ দেন। পরে আসামি মুন্সি মুহিবুল্লা অভির আইনজীবী সাইফুর রশিদ সবুজের যুক্তি উপস্থাপন অসমাপ্ত রেখেই দিনের কার্যক্রম সমাপ্ত করেন বিচারক। আগামী ১৫, ১৬ এবং ১৭ জানুয়ারি এই মামলায় আসামি পক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করে আদালত। এদিকে মামলার অন্যতম আসামি বিএনপির সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে আদালতে হাজির ব্যতিরেকে মামলার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং হাসপাতালে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য নির্দেশনা চেয়ে আবেদন নাকচ করে দিয়েছে আদালত। এ সময় আদালত বলে— কারাবন্দী আসামির হাজির ব্যতিরেকে মামলার কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিধান বিদ্যমান আইনে নেই। তবে আসামি পিন্টুর যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণে কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেওয়া হবে বলে আদালত জানায়।

গতকাল আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান, আইনজীবী আকরাম উদ্দিন শ্যামল, অ্যাডভোকেট ফারহানা রেজা, মো. আমিনুর রহমান, আবুল হাসনাত, কাজী ইলিয়াসুর রহমান, আশরাফ হোসেন তিতাস প্রমুখ।

দিনের কার্যক্রম শুরু হলে বুধবারের অসমাপ্ত বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন আসামি মুন্সি মুহিবুল্লা ওরফে অভির আইনজীবী সাইফুর রশিদ সবুজ। তিনি যুক্তি উপস্থাপনের সময় অন্য একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া আসামি শরীফ সাইফুল আলম বিপুলের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শরীফ সাইফুল আলম বিপুল নিষ্ঠুর নির্যাতনের ফলে মানসিক ভারসাম্য হারানো অবস্থায় আসামি মুন্সি মুহিবুল্লার নাম বলেছে। মুন্সি মুহিবুল্লা কোনো ভাবেই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। শুধু মুফতি হান্নানের ছোট ভাই হওয়াটাই মুহিবুল্লার অপরাধ। শরীফ সাইফুল আলম বিপুলের জবানবন্দি হাই কোর্ট রুলসের পরিপন্থী হয়েছে। তিনি কাগজ লেখা পড়ে পড়ে যুক্তি উপস্থাপন করছিলেন।

এ সময় বিচারক আইনজীবী সাইফুর রশিদ সবুজকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘এই মামলাটা অনেক বড় একটি মামলা। এ ধরনের মামলায় লিখে লিখে আরগুমেন্ট হয় না। এখনো যদি লিখে লিখেই আরগুমেন্ট করতে হয় তাহলে পাঁচ বছর ধরে কী করলেন?’ বিচারক বলেন, ‘যখন আরগুমেন্ট করবেন বিচারকের সঙ্গে আপনার আই কন্ট্রাক্ট হতে হবে। না হলে বিচারকের মাথায় কিছু ঢুকবে না। আর আমি না বুঝলে লিখতেও পারব না।’

আইনজীবীর উদ্দেশে বিচারক আরও বলেন, ‘এখানে আপনার আসামির পক্ষে কী আইন আছে, হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে কী ডিসিশন আছে, তা দেখাতে হবে।’

এরপর আবার আইনজীবী সাইফুর রশিদ সবুজ তার বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। এবার তিনি আসামি জাহাঙ্গীর আলমের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি তুলে ধরতে থাকেন। এ পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘এত বড় কেসের আরগুমেন্ট এটা না, এই ধরনের কেসে ফ্যাক্ট দিবেন ছোট। আসামির পক্ষে ল’ পয়েন্ট দিতে হবে বেশি। আর আপনি যে জাহাঙ্গীর আলমের জবানবন্দি পড়ছেন, এই একই জবানবন্দি তো তার আইনজীবীও পড়বে। এতে অহেতুক আদালতে সময় নষ্ট হচ্ছে।’ এ সময় আইনজীবী সাইফুর রশিদ সবুজ পরবর্তী তারিখে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আসবেন বলে দিনের কার্যক্রম মুলতবি করার আবেদন জানান।

এই মামলায় এর আগে পলাতক ১৮ আসামির মধ্যে হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, বিএনপি নেতা সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ এবং বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরীসহ আরও আট আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীরা আদালতে তাদের যুক্তি উপস্থাপন সমাপ্ত করেন। এসব আইনজীবীর সবাই নিজেদের আসামিদের নির্দোষ দাবি করে খালাস দাবি করেন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এই নির্মম হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমানসহ ২৪ জন প্রাণ হারান। অল্পের জন্য বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ হামলায় শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন।

২১ আগস্টের ওই নৃশংস হামলায় পৃথক দুটি মামলায় মোট আসামি ৫২ জন। এর মধ্যে ৩ আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদ, জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান এবং শরীফ সাইফুল আলম বিপুলের অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তারেক রহমান, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, মেজর জেনারেল (এলপিআর) এ টি এম আমিন, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দারসহ ১৮ জন এখনো পলাতক।

সর্বশেষ খবর