বৃহস্পতিবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
ছাত্রলীগে হলোটা কী

ঢাবিতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, উত্তেজনা

সারা দেশে ২৯ জানুয়ারি ধর্মঘট

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য কার্যালয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মঙ্গলবারের অবরোধ কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উত্তেজনা অব্যাহত রয়েছে। ওই সংঘর্ষের জন্য একে অন্যকে অভিযুক্ত করে গতকাল পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছে ছাত্রলীগ ও প্রগতিশীল ছাত্রজোট। এ ছাড়া ছাত্রলীগ নেতাদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ‘নিপীড়নবিরোধী’ শিক্ষার্থীরা।

‘উপাচার্যকে লাঞ্ছিতকারীদের’ শাস্তির দাবিতে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীর’ ব্যানারে মানববন্ধন করে ছাত্রলীগের সমর্থকরা। মানববন্ধন শেষে উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে তাদের অবস্থান কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের নেতারা যোগ দেন। উপাচার্য কার্যালয়            অবরোধকারীদের ছাত্রলীগ ‘বাম সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করে। তারা অভিযোগ করেন, ঘেরাওয়ের সময় উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করা হয়। অন্যদিকে উপাচার্য কার্যালয় অবরোধের সময় বাম নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনাকে ‘কালো অধ্যায়’ হিসেবে অবহিত করেছে ‘প্রগতিশীল ছাত্রজোট’। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলন থেকে জোট নেতারা হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবি জানান। অন্যথায় ২৯ জানুয়ারি সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন তারা। এ ছাড়া হামলাকারী ছাত্রলীগ নেতাদের বিচারের দাবিতে গতকাল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে ‘নিপীড়নবিরোধী’ শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মিথ্যাচারের প্রতিবাদ জানান।

উপাচার্যকে লাঞ্ছিতকারীদের বহিষ্কার দাবি ছাত্রলীগের : মঙ্গলবার ঢাবি উপাচার্যকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে ‘বাম সন্ত্রাসীদের’ বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি থেকে তারা এ দাবি জানান। এ সময় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, ঢাবি শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান, সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স উপস্থিত ছিলেন। ‘উপাচার্যের ওপর আক্রমণ, শিক্ষার্থী বোনদের শারীরিক লাঞ্ছনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ বিনষ্টকরণ ও শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্টকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি’তে ছাত্রলীগের সহায়তায় ‘সচেতন শিক্ষার্থীদের’ ব্যানারে এ অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। এর আগে অপরাজেয় বাংলায় মানববন্ধন করেন তারা। অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে ছাত্রলীগের ঢাবি শাখা সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেন, যারা উপাচার্যের ওপর আক্রমণ করেছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে। আন্দোলনের নামে কাউকে অরাজকতা করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে তাহলে ছাত্রলীগ তাদের শক্ত হাতে প্রতিরোধ করবে।

ছাত্রলীগের ঢাবি শাখা সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স বলেন, ঢাবির ছাত্ররা কোনো অপশক্তির সঙ্গে আপস করবে না। কেউ অধিভুক্তকে পুঁজি করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করলে তাদের শক্ত হাতে দমন করা হবে।

হামলার শিকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন : মঙ্গলবারের ঘটনায় ছাত্রলীগের হামলায় আহত সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে হামলার বর্ণনা দেন। তারা হলেন— গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র মাসুদ অপু এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী দীপ্তি।

 

মাসুদ অপু বলেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের কাছে যৌন হয়রানির বিচার দাবি করেন। এরকম ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কয়টা বিচার করে তার উদাহরণ শুনতে চান। কিন্তু উপাচার্য এসে একাডেমিক অ্যাডভান্স কমিটির মিটিংয়ের কথা বলে স্থান ত্যাগ করতে চাইলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা বলেন, সমস্যার সমাধান যে মিটিংয়ে  হয় না, সে মিটিং করে কী হবে।  ঠিক এই মুহূর্তে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসে তাদের বেধড়ক পেটাতে শুরু করে।

ছাত্রলীগের হামলার শিকার দীপ্তি বলেন, আমাদের আন্দোলনে দফায় দফায় ছাত্রলীগ হামলা চালায়। একপর্যায়ে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে চতুর্দিক থেকে ছাত্রলীগ দ্বারা ঘেরাও থাকা আমরা বের হতে গেলে তারা ভয়ঙ্করভাবে হামলে পড়ে। তিনি বলেন, মিছিল নিয়ে যখন বের হওয়ার চেষ্টা করছি, তখন সিনেট ভবনের পাশে আমার ওপর হামলা করে বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণী শায়লা। সে আমাকে বেধড়ক মারধর করে, কিল-ঘুষি মারে। আমার কাপড় ছিঁড়ে দেয় তারা।

ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজিরকেও হামলাকারীরা মারধর করে বলে জানান তিনি। দীপ্তি বলেন, বেনজির আপাকে ছাত্রলীগের নারীনেত্রীসহ ছাত্রলীগ নেতারা মারধর করেন। তার বুকে-পেটে তারা লাথি মারে। অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগের ছাত্র ফারহান শাহরিয়ার পুলক বলেন, উপাচার্য কার্যালয় থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যখন রেজিস্ট্রার ভবনের গেট দিয়ে বের হচ্ছিলাম, তখন আন্দোলনরত একজনকে ছাত্রলীগের ১০-১২ নেতা-কর্মী মিলে মারছিলেন। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে সহায়তা করি। উনি যেতে পারলেও আমার ওপর হামলা করে তারা। গেট থেকে মারতে মারতে সূর্যসেন হলের সামনে ফেলে আসে আমাকে।

চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্রী সামান্থা শারমিন বলেন, উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। স্যারের ওপর হামলা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবৃতিতে যে ধরনের অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন করছে, তা ভিত্তিহীন এবং ছাত্রলীগের ওপর হামলার অভিযোগ হাস্যকর। সংবাদ সম্মেলন শেষে চার দফা দাবিতে প্রগতিশীল ছাত্রজোট এবং প্রক্টরের পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবিতে ‘নির্যাতনবিরোধী’ শিক্ষার্থীরা মধুর ক্যান্টিন থেকে আলাদা আলাদা মিছিল নিয়ে বের হয়।

প্রগতিশীল ছাত্র জোটের ধর্মঘট :  ২৯ জানুয়ারি সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করেছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট। এ ছাড়া আগামীকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে সংহতি সমাবেশ এবং ২৮ জানুয়ারি সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে তারা। গতকাল ঢাবি মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের সমন্বয়ক ইমরান হাবীব রূমন এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন। প্রগতিশীল ছাত্র জোটের মধ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ঐক্য ফোরাম, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে তারা চার দফা দাবি পেশ করেন। এগুলো হলো— আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার, ১৫ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সঙ্গে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও মামলা প্রত্যাহার, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় প্রশাসনকে বহন করা এবং অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট নিরসন করা। সংবাদ সম্মেলন থেকে ঘটনার সঠিক বিচার করার জন্য বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানানো হয়। প্রগতিশীল ছাত্র জোট একটি গণতদন্ত কমিটি করবে বলেও জানায়। ডাকসু নির্বাচন বানচাল করার উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টার অংশ হিসেবে আন্দোলনরতদের ওপর হামলা করা হয়েছে বলে ইমরান হাবিব দাবি করেন।

প্রসঙ্গত, সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল চেয়ে ১১ জানুয়ারি থেকে আন্দোলনে নামেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ১৪ জানুয়ারি তাদের আন্দোলনে যোগ দেয় বাম সংগঠনগুলো। আন্দোলনকারীরা ১৫ জানুয়ারি উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এসে তাদের একজনকে মারধর করেন এবং ছাত্রীদের নিপীড়ন করেন বলে অভিযোগ ওঠে। নিপীড়নের বিচার চেয়ে ১৭ জানুয়ারি কয়েকটি বাম সংগঠনের ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রব্বানীকে অবরুদ্ধ করেন। তারা নিপীড়নকারীদের বিচার করতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। ভাঙচুরের ঘটনায় ঢাবি প্রশাসন ৫০-৬০ জন অজ্ঞাতনামা শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করে। সর্বশেষ মঙ্গলবার ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’-এর ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থী ও বাম ছাত্র সংগঠনের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করে উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাও করে। তারা ফটকের তালা ভেঙে উপাচার্য কার্যালয়ের বারান্দায় অবস্থান নেন। সেখানে দুপুর আড়াইটার দিকে উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দোষীদের বিচার হবে বললে বিক্ষুব্ধরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ সময় ছাত্রলীগ এসে উপাচার্যকে উদ্ধার করে। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দফায় দফায় আন্দোলনরতদের ওপর হামলা করেন। এতে ছাত্রীসহ ৫০ জন আহত হন। এদের মধ্যে গুরুতর আহত ১০ জন এখনো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর