মঙ্গলবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

টান টান উত্তেজনা ঢাকায়

মাঠ দখলে মরিয়া দুই দল, সর্বোচ্চ সতর্কতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা

মাহমুদ আজহার ও রফিকুল ইসলাম রনি

টান টান উত্তেজনা ঢাকায়

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে টান টান উত্তেজনা চলছে। দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হবে নাকি তিনি খালাস পাবেন, আর সাজা হলে কেমন হবে পরিস্থিতি তা নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা আছে। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন পর আবার মুখোমুখি দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।

৮ ফেব্রুয়ারি মাঠ দখলে মরিয়া উভয় দল। পাল্টাপাল্টি প্রস্তুতি চলছে দুই পক্ষেই। রায় নেতিবাচক হলে প্রতিবাদ কর্মসূচির প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। আর রাজপথে কোনো ধরনের সহিংসতা করতে না দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। ওইদিন গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলারও ঘোষণা দিয়েছে সরকারি দল। যে কোন অরাজক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ সতর্কতায় থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধারণা, দুর্নীতি মামলায় দলের চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক রায় হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে বাইরে রাখতেই সরকার এ পথে হাঁটছে বলে তারা মনে করে। সে কারণে রায় নেতিবাচক হলেই আন্দোলনে যাবে বিএনপি। এ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে কার পরামর্শে দল চলবে সেসব সিদ্ধান্তও হয়েছে। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই গুলশান বিএনপি নেত্রীর বাড়ি থেকে পুরান ঢাকার বকশীবাজারের বিশেষ আদালত পর্যন্ত রাজপথে থাকবে দলটির নেতা-কর্মীরা। এ জন্য দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে। সহযোগী সংগঠনগুলোকেও সেভাবে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। গুলশান থেকে বকশীবাজার পর্যন্ত খালেদা জিয়া যে পথ দিয়ে আদালতে যাবেন সে পথে মানববন্ধনের মাধ্যমে নেতা-কর্মীরা ঢাকার শক্তি জানান দেবেন। তবে কোনো ধরনের উসকানি দেবে না তারা। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হবে বলে মনে করেন তারা। সে কারণে ওইদিন রাজপথে বিএনপি ব্যাপক সহিংসতা করতে পারে বলে তাদের কাছে খবর আছে। তাই ওইদিন সকাল থেকে রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় সতর্ক থাকবে আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠন ও ১৪ দলের নেতা-কর্মীরা। তারা পরিস্থিতির আলোকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর সকল থানাসহ এবং সারাদেশে পুলিশ সুপারদের প্রয়োজনীয় নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে সব ধরনের নৈরাজ্য পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত আছে। কোনো নাশকতা ও নৈরাজ্য করতে দেওয়া হবে না। এদেশের মানুষ তা সহ্য করবে না। 

এদিকে গতকাল কেন্দ্রীয় ১৪ দল বৈঠক করে খালেদা জিয়ার রায়ের দিন মাঠে সতর্ক থাকার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সংগঠনের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ১৪ দলের নেতা-কর্মীরা সতর্ক থাকবে। শুধু ৮ ফেব্রুয়ারি নয়, নির্বাচন পর্যন্ত সজাগ ও সতর্ক থাকবে তারা। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে বর্ধিত সভা করে তারা রাজপথে সক্রিয় থাকার কথা জানান দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আজ গুলিস্তানের দলীয় কার্যালয়ে বর্ধিত সভার আয়োজন করেছে। একইভাবে আজ আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গে দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যৌথ সভার আয়োজন করা হয়েছে। সভা থেকে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির করণীয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। কারা কোথায় এবং কীভাবে অবস্থান করবেন সেটা নির্দেশনা দেওয়া হবে। রাজনীতির অন্দরমহলে আলোচনা হচ্ছে, বকশীবাজারের আদালত থেকে কোন দিকে যাবেন খালেদা জিয়া। নানা আলোচনা। নানা মত। খালেদা জিয়া খালাস পেলে বিকল্পের আলোচনা নেই। তিনি সোজা গুলশানে যেতে পারবেন। অন্য কোথাও যাওয়াও তারই মর্জি। রায় বিপক্ষে গেলে গন্তব্য কোন দিকে হবে। বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় সাধারণত কারও দণ্ড হলে কারাগারে না গিয়ে আপিলের সুযোগ নেই। তৃণমূল অবশ্য খালেদা জিয়ার বিপক্ষে রায় গেলে হার্ডলাইনে যাওয়ার পক্ষে। ঢাকার বাইরের নেতাদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাদের মনোভাবের কথা জানিয়েছেন। সূত্রমতে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস, জ্বালাও পোড়াও করা শুরু করে তাহলে স্থানীয় জনগণ, পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে রাজপথে সহিংসতা করতে দেবে না তারা। মূলত জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপিকে সাংগঠনিক শক্তি দেখানোর সুযোগ দিতে নারাজ ক্ষমতাসীন দল। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপি মাঠ গরম করার চেষ্টা করছে। তবে আমরা কোনো উসকানি দেব না। কোনো উসকানিতে পা দেব না। আমরা কারও সঙ্গে পাল্টাপাল্টিতে যাব না। তবে তারা যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা যা প্রয়োজন তা-ই করবে। কিন্তু আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবিলা করতে হবে। বিএনপি সূত্র জানায়, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি আদালত পাড়ায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটাতে চায় বিএনপি। গুলশান থেকে বিভিন্ন পয়েন্ট ভিত্তিক এলাকায় নেতা-কর্মীরা থাকবে। কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটরিং করা হবে। রায় যাই হোক, সবকিছু ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করবে মাঠের বিরোধী দল। বিএনপি থেকে কোনো ধরনের উসকানি দেওয়া হবে না। তবে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ যদি কিছু করে তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেবে দলটি। এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ম্যাডামকে নিয়ে আদালতে যাব। আমরা কোনো ধরনের সহিংসতা বিশ্বাস করি না। ধৈর্য ধরে আদালত এলাকায় উপস্থিত থাকব। যেহেতু মামলাটি রাজনৈতিক, তাই রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবিলা করব। সূত্রমতে, সর্বশেষ বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে শান্তিপূর্ণভাবে সর্বোচ্চ ধৈর্য ধরে রাজপথে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনোভাবেই হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতেও যেন বিভেদ সৃষ্টি না হয় সে জন্য সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত ও স্থায়ী কমিটির পরামর্শক্রমে দল চলবে। আগামীকাল রাজধানীতে খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করবেন। সেখানে সামগ্রিক পরিস্থিতি তুলে ধরবেন তিনি।

উসকানিতে পা দেবে না ১৪ দল : ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার রায়কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের উসকানিতে পা দেবে না আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। তবে ঢাকা শহরের প্রতিটি স্থানে নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী পরিচালনা অস্থায়ী কার্যালয়ে ১৪ দলের বৈঠকে ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার রায়কে ঘিরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন শরিক দলের নেতারা। এ সময় বিএনপির কোনো ধরনের উসকানিতে ১৪ দলের নেতা-কর্মীদের পা না দেওয়ার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। বৈঠকে শরিক দলের নেতা নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বার বার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ছাড়াও আগামী নির্বাচনের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি না করার প্রস্তাব দেন আওয়ামী লীগ নেতা মৃণাল কান্তি দাস। সভায় আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ১৪ দল বিভাগীয় সমাবেশ করবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিক ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বিএনপি রায়কে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খা সৃষ্টি করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। কারণ জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদের। তিনি বলেন, বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যেসব প্রস্তাব দিয়েছে তা অসাংবিধানিক। নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচন ভণ্ডুল করার চক্রান্ত করছে। তাদের এ চেষ্টা সফল হবে না। তিনি আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াত দীর্ঘদিন ধরে চক্রান্ত করছে, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, অসীম কুমার উকিল, আবদুস সোবহান গোলাপ, মৃণাণ কান্তি দাস, জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদ দিলীপ বড়ুয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর