সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করাই তার নেশা

সাঈদুর রহমান রিমন ও গোলাম রাব্বানী

সংবাদপত্র আর সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা মোতাহার হোসেনের নেশায় পরিণত হয়েছে। এতে বিকৃত আনন্দ পান লালমনিরহাট-১ আসনের এই এমপি। লালমনিরহাটের এক সাংবাদিক ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা করেন মোতাহার পরিবার ও তার লোকজন। তিন বছর ধরে ওই সাংবাদিক নিজের বাড়িতে যেতে পারেন না। তাঁর পরিবারের সদস্যসহ নিকটাত্মীয়রা একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন, জেল খেটেছেন। গত ২৮ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, প্রকাশক ময়নাল হোসেন চৌধুরী ও দুই প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মামলা করেন এই মামলাবাজ এমপি। গতকালও তার দুই সহযোগী বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেন। এ পর্যন্ত কেবল বাংলাদেশ প্রতিদিনের বিরুদ্ধে এই এমপি, তার পরিবার ও সহযোগীরা এক অজানা আক্রোশে পাঁচটি মামলা করেছেন।

হাতীবান্ধা উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণেই লালমনিরহাটের সাংবাদিক পরিবারটির বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়েছে। হাতীবান্ধার এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে থানায় চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগ এনে তাঁকে বাড়িছাড়া করা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় একাধিক সাংবাদিককে প্রাণনাশের হুমকিও দেন মোতাহারের লোকজন। অন্যদিকে হাতীবান্ধার এক প্রবীণ সাংবাদিক মোতাহারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তার শিক্ষিকা-স্ত্রীকে (একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা) চাকরি থেকে সাসপেন্ড করেন সেই সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা মোতাহার হোসেন।

শুধু তাই নয়, মোতাহার হোসেন মামলা করেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন ও দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে। এর আগে তার ছোট ভাই রন্টুর ঠিকাদারি কাজে অনিয়মের খবর প্রকাশ করায় বাংলাদেশ প্রতিদিন ও কালের কণ্ঠের বিরুদ্ধে মামলা করেন এই ঠিকাদার ভাই। মোতাহার এমপি এলাকায় ঘোষণা দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে খবর ছাপা হলেই তিনি মামলা করবেন। এলাকায় ‘সিপাহি’ হিসেবে পরিচিত মোতাহার সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করায় এখন সারা দেশে ‘মামলাবাজ’ হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন। পত্রিকায় ‘গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর নৈরাজ্য’ শিরোনামে প্রতিবেদন লিখেছিলেন সাংবাদিক সায়েম সাবু। তার জের হিসেবে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের লেলিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক পোষ্য ও স্বজনরা ওই সাংবাদিক ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৩২টি মামলা রুজু করেন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওই মাসেই সায়েম, তাঁর তিন ভাই, বোন ও ভগ্নিপতিসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় নারী নির্যাতনের মামলা। এরপর গত আড়াই বছরে সায়েমের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টাকা ছিনতাই, ধানের চারা উপড়ে ফেলা, সার ও বীজ ছিনতাই, গাড়িতে আগুন, হামলা-ভাঙচুর, জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা করা হয়। জানা গেছে, মামলা লড়তে লড়তে পরিবারটি পর্যুদস্ত। বর্তমানেও তাদের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা চলমান।  এর আগে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘রেশন ডিলার সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহারের শত কোটি টাকা’ শিরোনামে একটি তথ্যবহুল অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি ও তার সহযোগীরা। পরিণতিতে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম ও স্থানীয় সাংবাদিকের ওপর নেমে আসে মামলার খড়গ। এর পরপরই আলোকিত বাংলাদেশ-এ প্রকাশিত হয়— ‘লালমনিরহাট-১ : চ্যালেঞ্জে এমপি মোতাহার’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন। এ প্রতিবেদনের ব্যাপারেও মোতাহার হোসেন মামলা দায়ের করেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ-এর সম্পাদক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে। এরপর বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘লালমনিরহাটে মোতাহার সাম্রাজ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে গতকাল আবারও বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজামসহ চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন এমপির দুই সহযোগী। বিতর্কিত এমপি মোতাহার হোসেনের ব্যক্তিগত দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি অভিযোগ নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জের ধরে লালমনিরহাটে দলীয় সমাবেশ, প্রতিবাদ মিছিল ও পত্রিকা পোড়ানো এবং সম্পাদকের কুশপুতুল দাহ করার মতো বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তিনি। এ নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যেও নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বলেছেন, দলের কেন্দ্রীয় কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়নে একশ কর্মী-সমর্থক জড়ো করা কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ এমপির ব্যক্তিগত ও পরিবার সংশ্লিষ্ট অপরাধ-অপকর্ম, দুর্নীতির অভিযোগ সামাল দিতে সংগঠনকে ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এমনকি আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা পত্রিকাবিরোধী জ্বালাও-পোড়াও মিছিলে হাজির না হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

সর্বশেষ খবর