শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি স্বাধীনতা সংগ্রাম

অনুপম সেন

ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি স্বাধীনতা সংগ্রাম

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যে ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল তার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মহান সংগ্রামে। আজ থেকে প্রায় সহস্র বছর আগে প্রাকৃত ভাষার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম। বাংলা ভাষার জন্মের সেই ঊষালগ্নেই বৌদ্ধ, চর্যা ও দোহার কবি ভূষক দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন, তিনি বাঙালি। বৈষ্ণব পদাবলী, মঙ্গল কাব্য ও আখ্যানমূলক কাব্যকে আশ্রয় করে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে দশম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে। বৈষ্ণব পদাবলী বিশ্ব সাহিত্যের লিরিক বা গীতিকবিতার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ সংযোজন। ষোড়শ শতকের বঙ্গে এক ধরনের অপরিণত রেনেসাঁসের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু ইউরোপের রেনেসাঁস যেমন বণিক পুঁজিকে অবলম্বন করে শ্রেণিদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের ও জাতীয় রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল, বাংলাদেশে সে ধরনের কোনো বিবর্তন ঘটেনি। কেন ঘটল না তা বোঝা প্রয়োজন। বাংলা, অসমিয়া, ওড়িয়া, হিন্দি, গুজরাটি ইত্যাদি লৌকিক মাতৃভাষার বিকাশের সূচনা হয়েছিল প্রায় এক হাজার বছর আগে। প্রায় একই কালে ইউরোপেও বিভিন্ন লৌকিক মাতৃভাষা যেমন ইতালি, প্রভেনকাল, স্প্যানিশ, ইংরেজি, ফরাসি প্রভৃতি ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল। লৌকিক ভাষাকে অবলম্বন করেই ইউরোপে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে, বিভিন্ন জাতীয় রাষ্ট্রেরও উদ্ভব হয়। ইউরোপে জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভাষার যেমন একটা ভূমিকা ছিল, তেমনি বিরাট ভূমিকা রয়েছে উৎপাদন পদ্ধতির, শ্রেণি সংগ্রামের। উৎপাদন শক্তির বিকাশ ও শ্রেণিসংঘাতের মধ্য দিয়ে জনগণের অধিকার প্রাপ্তিই জাতীয়তাবাদের আর্থ-সামাজিক ভিত্তি রচনা করেছিল।মধ্যযুগে, ভারতবর্ষের মতো ইউরোপেও নানা ভাঙাগড়া ঘটেছে, শার্লেমনের অধীনে ইউরোপের বিরাট অংশ ক্যারোলেনজিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁর সাম্রাজ্য তাঁর তিন প্রপৌত্রের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। একাদশ দ্বাদশ শতক থেকে লৌকিক মাতৃভাষার মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে-রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল, তাই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এক ভাষাভাষী লোক অনুভব করতে থাকে তাদের স্বার্থ অভিন্ন। দেশের ও জাতির উন্নতির সঙ্গে তাদের ব্যাস্টিক উন্নতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই ভাবনা ও ধারণা এসেছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকারবোধের বিকাশের ফলেই। বাংলাদেশের বাঙালির দুর্ভাগ্য তাকে এ ধরনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিজয় অর্জন করার পর বাঙালি দেখল, ভাষার অধিকার পেলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তার স্বাধীনতা অপ্রাপ্যই রয়ে গেছে। তাই, ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। তবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিকে পূর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যে মহান স্বপ্নে উজ্জীবিত করেছিল সেই স্বপ্নকে এখনো আমরা পূর্ণতা দিতে পেরেছি কি? লেখক : শিক্ষাবিদ

সর্বশেষ খবর