মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

লরির ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে গেল বাস, নিহত ৯

নিজস্ব প্রতিবেদক ও সোনারগাঁ প্রতিনিধি

লরির ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে গেল বাস, নিহত ৯

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতিদিনের মতো রোগী দেখায় ব্যস্ত চিকিৎসকরা। বেলা আড়াইটার দিকে হঠাৎ নারী, শিশুসহ ২১ জন গুরুতর অবস্থায় একসঙ্গে হাসপাতালে এলে চমকে ওঠেন তারা। একদিকে রোগীদের আর্তনাদ, সেই সঙ্গে স্বজনদের কান্নায় মুহূর্তে পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। মৃত্যুর খবর জানতে পেরে স্বজনরা চিৎকার শুরু করেন। লাশ জরুরি বিভাগ থেকে সরিয়ে নেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা।

এর মধ্যেই চিকিৎসকরা দুই শিশুসহ চারজনকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে হেনা বেগম নামে আরও একজনের মৃত্যু হয় চিকিৎসাধীন অবস্থায়। একই পরিবারের নিহত চার সদস্য হলেন কাতারপ্রবাসী ইলিয়াস হোসেন, তার বড় ভাই মফিজ (৪৭), ছেলে ইমান (৮), বোন মিনু আরা (৩৬)। নিহত অন্যরা হলেন হেনা আক্তার (১৮), শুভ সাহা (১৮)।

গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ত্রিপুরদি এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি লরির সঙ্গে যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষে ঘটনাস্থলে চারজন এবং ঢামেক হাসপাতালে আনার পথে আরও তিনজন, সর্বশেষ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাস্থলে নিহত চারজনের লাশ সোনারগাঁ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠিয়েছে পুলিশ। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ১৫ জনের মধ্যে দুজনকে পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি রোগীদের সেবা দেওয়ার।’

ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নিহত ইলিয়াসের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত অবগত ছিলেন না তাদের পরিবারের চারজন এরই মধ্যে মারা গেছেন। তার মাথা ফেটেছে, হাত-পা ভেঙে গেছে। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বেড়েরা উত্তরপাড়া ১৩ নম্বর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানবাড়ি। তার বাবা মৃত লতিফ মিয়া। নিহত চারজনকে ঢামেক মর্গে এসে শনাক্ত করেন ইলিয়াসের চাচাতো ভাই ওমর সানি।

এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, তার ভাই কাতারপ্রবাসী ইলিয়াসের ফ্লাইট ছিল গত রবিবার। এজন্য শনিবার তার পরিবারের সাতজন ঢাকায় এসেছিলেন। তবে ফ্লাইটের তারিখ পরিবর্তন হওয়ায় তারা গতকাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ভাতিজা রাজু (১৯) ঢামেকে চিকিৎসাধীন।

চিকিৎসাধীন আরেকজন আবদুল হাকিম। তিনি বলেন, তাদের পরিবারের পাঁচজন চার দিন আগে নরসিংদীর পাঁচদোনায় আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার গৌরীপুর। নরসিংদী থেকে লোকাল বাসে চিটাগাং রোডে এসে ডিসিএম পরিবহনের একটি বাসে উঠেছিলেন। বাসে ওঠার পর রাস্তার মাঝে সোনারগাঁ রোডে তাদের বাস একটি রিকশাকে ঘেঁষে অনেক দূর নিয়ে যাচ্ছিল। ধরা পড়ার ভয়ে বাসচালক সর্বোচ্চ গতিতে বাসটি চালাতে থাকেন। এ সময় যাত্রীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। স্পিড কমাতে বললেও চালক তাতে কান দেননি।

তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে বাসটি ১৮ চাকার লরির পেছনে সজোরে আঘাত করে। এতে বিকট শব্দ হয়, গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কিছু সময়ের জন্য আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় বাসের পেছনের জানালা দিয়ে আমাদের পরিবারের অন্য সদস্যরা নেমে এসেছেন।’

নিহত শুভ সাহার মা কাজল রানী সাহার আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠছিল হাসপাতালের পরিবেশ। এ দৃশ্য দেখে হাসপাতালে অবস্থানরত অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। হাউমাউ করে তিনি বলছিলেন, ‘বাবারে! তুই আমারে ফালাইয়া কই গেলি রে... এহন আমি কারে লইয়া বাঁচুমরে বাবা। ক্যাডা আমারে মা কইয়া ডাকব। বাবারে তুই আমার বুকে ফিরা আয়।...’

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার কাজল রানী সাহা ছেলে শুভ সাহাকে নিয়ে গাজীপুরে মেয়ে তাপসী রানী সাহার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন পাঁচ দিন আগে। গতকাল মেয়ের জামাই নিমাই সাহা কাঁচপুর পর্যন্ত এসেছিলেন তাদের গাড়িতে তুলে দেওয়ার জন্য। কিছু সময় পরই ঘটে দুর্ঘটনা।

আহত ১৫ : জরুরি বিভাগ থেকে আহত ১৫ জনকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। পরে দুজনকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। আহতরা হলেন জান্নাত (১০), আফ্রিন (১৫), রিপন (১৫), হাসান (১৮), ফরহাদ (১৮), মিজান (১৫), মাজেদা (৫০), ইলিয়াস (৩৫), কুদ্দুস (৫০), হালিম (৪৪), আহসান (১৮), ফরহাদ (১৯), আরিফ (২৭), আবুল কালাম (৩২), রাজু (২৫) ও অজ্ঞাত মহিলা (২০)। তাদের কারও মাথা, কারও দুই পা, কারও বুক, কারও শরীরের বিভিন্ন অংশ জখম হয়েছে। সবার অবস্থাই গুরুতর বলে চিকিৎসকরা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর