শিরোনাম
সোমবার, ৫ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করি

মোস্তফা মহসীন মন্টু

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করি

তখন আমার বয়স ২৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এমএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মাতৃভূমিকে ঔপনিবেশিক শাসন মুক্ত করতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে রাজপথে আন্দোলন করছি। তবে এর সূচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও আগে। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার আন্দোলনকে ধীরে ধীরে এক দফা বা স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করেছেন। ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবীসহ এদেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। এ বিজয় মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকরা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঠেকাতে না পেরে তারা শুরু করে নানা ষড়যন্ত্র। এদিকে ১৯৭০ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের এক মিছিলে বাধা দিলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বেধে যায় ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটি মিছিলের সঙ্গে এই সংঘর্ষে পাকিস্তানের একজন ক্যাপ্টেন নিহত হন। এ ঘটনায় আমি, ছাত্রনেতা কামরুল আলম খান খসরু এবং আমার ভাই সেলিম জাহানসহ ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়। একই বছরের জুন মাসে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে আমি গ্রেফতার হই।  এরপর দীর্ঘ ৯ মাস কারা ভোগের পর একাত্তরের ১ মার্চ আমরা জেল ভেঙে বের হই। একইদিন ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য আগে ডাকা জাতীয় পরিষদ সভা স্থগিত ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার পরে সারা বাংলায় মানুষ গর্জে ওঠে।

২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ডাকসু ভিপি হিসেবে সেদিন রব ভাইয়ের (আ স ম আবদুর রব) হাতে পতাকা প্রদর্শনের দায়িত্ব পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৩ মার্চ থেকে আমরা অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করেছিলাম। এদিনই পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে গুলি ছোড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় সংগীত, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ ও বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। তিনি সশস্ত্র গার্ড পরিদর্শন করেন। এদিনই শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, কামরুল আলম খান খসরু, আমি এবং ছাত্রলীগের কয়েকজনকে বঙ্গবন্ধু ডেকে বলেছিলেন, পরিস্থিতি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। এরপর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামে ডাক দিয়ে যুদ্ধের সময় কি করতে হবে তারও দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের পর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। তা বুঝতে পেরেই ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সব অফিস আদালতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন মিছিলসহ আমরা ধানমন্ডি-৩২ নম্বর গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিলাম।

২৫ মার্চ রাত ৯টায় ধানমন্ডি-৩২ নম্বর বাড়িতে আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, তোমরা নিরাপদ স্থানে চলে যাও। বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি চলে গেলে সবাইকে মেরে ফেলবে, তোমরা যাও। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বের হয়ে আমি ইকবাল হলে আসি, সেখানে কিছু অস্ত্র ছিল, দুটো গাড়িতে সেগুলো তুলি। রাত ১১টায় এস এম হলের সামনে ট্যাংকসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে জানতে পেরে আমি গাড়ি নিয়ে আজিমপুর দিয়ে হাজারীবাগ হয়ে কামরাঙ্গীরচর চলে আসি। এরপর নৌকা নিয়ে অস্ত্রসহ কেরানীগঞ্জে পৌঁছে যাই। ১৫ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় অতর্কিত হামলা করে গণহত্যা শুরু করে, শহরের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ করে।

২৬ মার্চ কেরানীগঞ্জে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। এদিন লাখ লাখ মানুষ ঢাকা থেকে পালিয়ে কেরানীগঞ্জের দিকে চলে আসতে থাকে। ঢাকা থেকে শেখ ফজলুল হক মনি, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, আবদুল মালেক উকিল, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী কেরানীগঞ্জে আসেন। তারপর আমাদের বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ফরিদপুর হয়ে মুজিবনগরে চলে যান। পরে সেখানে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের তত্ত্বাবধানেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে।

 ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে আসা পলায়নপর মানুষের খাদ্য ও আশ্রয় এবং ফরিদপুর হয়ে ভারত যাওয়ার বা অন্যত্র যাওয়ার ব্যবস্থা করি। পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করি। এ সময় আমরা কেরানীগঞ্জ থানা ঘেরাও করে আমরা যুদ্ধের জন্য অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করি। থানায় কয়েকজন বাঙালি পুলিশ ছিল তাদের সঙ্গে নিয়ে আসি। ২ এপ্রিল ফজরের আজানের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কেরানীগঞ্জে হামলা চালায়। ভোর থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত প্রায় সাত ঘণ্টার অপারেশনে এদিন স্থানীয় ও ঢাকা থেকে এসে আশ্রিত প্রায় সাড়ে চার হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। এর কয়েকদিন পরে আমি মুজিবনগরে চলে যাই। সেখানে ভবেরপাড়া আমবাগিচা ক্যাম্পের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। মনি ভাই ও সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে আমি সারা দেশ থেকে বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আসা ছাত্রলীগ নেতাদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য দেরাদুন ও হাফলং পাঠানোর ব্যবস্থা করি। পরে আমাকে কলকাতা শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর দেরাদুনে দুই মাস ট্রেনিং নিয়ে আমি আবার কেরানীগঞ্জে ফিরে আসি। ফিরে এসে কেরানীগঞ্জে গড়ে তুলি ১২টি মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। প্রশিক্ষণের সময় যুদ্ধ দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা থেকে আমাদের বিকল্প প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলি। একইসঙ্গে স্থানীয়ভাবে রাজস্ব সংগ্রহ, বিচার-শালিস করা ও স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণে যে দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল, তা যথাযথভাবে প্রতিপালন হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করি। পরে আমি কেরানীগঞ্জসহ ঢাকা দক্ষিণে ও ও কামরুল আলম খান খসরু আড়াই হাজারসহ ঢাকার উত্তরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করি। দেরাদুন থেকে ফিরে মহিউদ্দীন মুন্সীগঞ্জের দায়িত্ব নেয়। আমি তখন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) যা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে খ্যাত তার ঢাকা জেলা কমান্ডার। ২৭ নভেম্বর পাকিস্তান বাহিনী আবারও কেরানীগঞ্জে হামলা চালায়। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সামনা সামনি মরণপণ লড়াই। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দুই রাত এক দিন সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ৩০ নভেম্বর হানাদার বাহিনী স্যাবর জেট বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে আমাদের ওপর গোলা বর্ষণ শুরু করে। এ সময় আমরা কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ও সাভারের দিকে সরে যেতে বাধ্য হই। এ যুদ্ধে ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। আমাদের পক্ষ থেকে শহীদ হন কমান্ডার ওমর। এ ছাড়া আহত হন চার-পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা। পরে জেনেছি, এ যুদ্ধে প্রায় ১৪০০ পাকিস্তানি সেনা আমাদের ওপর হামলা করেছিল। পরে আমরা জিনজিরা থানা ঘেরাও করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করেছিলাম। তারপর যাত্রাবাড়ী, মতিঝিলসহ বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ওদের ভীত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলাম। এ সময় লিফলেট বিলি করে আমরা ঢাকা থেকে বাঙালিদের অন্যত্র চলে যেতে বলি। আর ঢাকায় খাদ্য সাপ্লাই বন্ধ করে দিই।

১৫ ডিসেম্বর রাতে কেরানীগঞ্জ থেকে চকবাজারের মধ্যদিয়ে ঢাকায় ঢুকলাম। রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দেয়াল ভেঙে আমার ভাই সেলিম জাহান ও অন্য রাজবন্দীদের মুক্ত করি। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা একত্রিশ মিনিটে পাকিস্তানিদের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু সেই বিজয়ের দিনেও আমাদের ঢাকায় যুদ্ধ করতে হয়েছে। সেদিন সকালে চকবাজার থেকে ঢাকা মেডিকেল পর্যন্ত পৌঁছতে আমাদের লেগেছিল নয় ঘণ্টা। সামনে এগোতে পদে পদে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে। ফলে ঢাকায় থেকেও সেদিন আমরা ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি।

লেখক : গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক

সর্বশেষ খবর