বুধবার, ৭ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

উদারমনা শিক্ষকরা কেন টার্গেটে

হুমায়ুন আজাদ, ড. ইউনুস, এস তাহের, শফিউল ইসলাম, রেজাউল করিম হত্যায় জঙ্গিরা

জয়শ্রী ভাদুড়ী ও মর্তুজা নুর

উদারমনা শিক্ষকরা কেন টার্গেটে

পড়ন্ত বিকালের রোদ মেখে মুক্তমঞ্চে পাতা সোফায় বসে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের ফেস্টিভ্যাল উপভোগ করছিলেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। অকস্মাৎ মাথার পেছনে ছুরি দিয়ে আঘাত করে বসে এক যুবক। রক্তে ভেসে যায় দেশবরেণ্য এই শিক্ষকের শরীর। পরে জানা যায়, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা করেছেন হামলাকারী ফয়জুর রহমান।

মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী শিক্ষকদের ওপর হামলা এটাই প্রথম নয়। এর আগে জঙ্গিদের ছুরি-চাপাতির কোপে আহত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছেন হুমায়ুন আজাদসহ আরও চারজন শিক্ষক। এ পর্যন্ত প্রগতিমনা শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের প্রতিটির নেপথ্যেই রয়েছে জঙ্গিবাদ।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রগতিশীল চিন্তার কারণেই হামলা হয়েছে ড. জাফর ইকবালের ওপর। জঙ্গিরা মনে করে শিক্ষকদের হত্যা করলেই জঙ্গিবাদের বিস্তার সহজ হবে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর এই হামলা স্বাধীনতাকামী বাঙালির চিন্তার ওপর আঘাত। কুসংস্কারমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার বাধা হিসেবে শিক্ষকদের সরিয়ে দিতে সক্রিয় রয়েছে এই বিপথগামী তরুণরা।’

একইভাবে রাতের অন্ধকারে জঙ্গিরা আঘাত হেনেছিল প্রথাবিরোধী প্রতিভাবান লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে জঙ্গিদের হামলায় ক্ষতবিক্ষত হন হুমায়ুন আজাদ। ওই বছরের ১২ আগস্ট উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানি যাওয়ার পর সেখানেই মারা যান তিনি। এরপর এটি হত্যা মামলা হিসেবে রূপ নেয়। সিআইডির পরিদর্শক লুত্ফর রহমান মামলাটির মূল তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মামলাটি তদন্তের পর ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল পাঁচ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন জেএমবির শূরা সদস্য মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন, হাফিজ মাহমুদ ও নূর মোহাম্মদ ওরফে সাবু। এরা নিষিদ্ধ জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসব ঘটনা আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। এ ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের সমাজের সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করেছে; যার ফলে জঙ্গিবাদের বড় নেটওয়ার্কগুলো ভেস্তে গেছে। তবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জঙ্গিরাই এখনো প্রগতিশীল মানুষের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে।’

জঙ্গিদের হামলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারিয়েছেন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষকরা। এ পর্যন্ত চারজন শিক্ষক নিহত হয়েছেন। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর ভোরে বাসা থেকে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ইউনুস। বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বিনোদপুর এলাকায় জঙ্গিদের অতর্কিত হামলার শিকার হয়ে নির্মমভাবে মারা যান তিনি। সিআইডি পুলিশ মামলার তদন্ত শেষে আট জেএমবি সদস্যকে আসামি করে এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দুই আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করে রাজশাহীর আদালত। অধ্যাপক ইউনুস হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরই ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের দুই দিন পর নিজ বাসভবনের পেছনে একটি সেপটিক ট্যাংকের ভিতর তার লাশ পাওয়া যায়। তাহের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে এক শিক্ষকসহ চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে হাই কোর্ট। এ মামলার সন্দেহভাজন অন্য আসামি তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি ও ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুবুল আলম সালেহীকে বেকসুর খালাস দেয় আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়। এরপর ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটির পাশে নিজ বাসভবনের একটু সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম শফিউল ইসলামকে। এই শিক্ষক হত্যাকাণ্ডেও পাওয়া যায় জঙ্গিসম্পৃক্ততা। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মহানগরীর শালবাগান এলাকায় নিজ বাসার কাছে খুন হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী। সে সময় রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক রেজাউস সাদিক জানান, দেশব্যাপী ব্লগার, মুক্তমনা, প্রগতিশীল ব্যক্তিদের টার্গেট কিলিংয়ের অংশ হিসেবে অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যা করেছে জঙ্গিরা। মামলার তদন্তে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান বলেন, ‘প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক মানুষকেই এরা মূলত টার্গেট করছে। এই জঙ্গিরাই মানুষকে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে যুবসমাজকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে। এ অপশক্তিগুলোই জাফর ইকবালের মতো মুক্তমনাদের ওপর হামলা করেছে।’ শিক্ষকদের ওপর হামলার ব্যাপারে নিন্দা জানিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শুধু ক্যাম্পাস নয়, এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের ওপর জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে এসে জঙ্গিবাদ সমূলে উৎপাটন করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর