সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথে দেশ

অনেক সূচকেই পাকিস্তান-ভারতের চেয়ে এগিয়ে

জুলকার নাইন

১৯৭০ সালের ৬ জুন। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয় এই ইশতেহারে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিশ্রুতি দেন যমুনা ও পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণের। দীর্ঘ পথপরিক্রমা শেষে ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি দাতা সংস্থার অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের চুক্তি করে বাংলাদেশ। কিন্তু দুর্নীতি, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও অপবাদ দিয়ে দুই বছর পর সেই চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। পরে বিশ্বব্যাংকের বাইরে অন্যদের কাছ থেকে অর্থায়নের চেষ্টা করা হয়। জাইকা, এডিবি, আইডিবি ছাড়াও চীন ও মালয়েশিয়ার কাছ থেকেও ফিরতে হয় খালি হাতে। কিছুতেই কিছু না হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন নিজস্ব অর্থায়নে বিশাল এ প্রকল্প বাস্তবায়নের। এখন ২০১৮ সালে এসে পদ্মা সেতু কোনো স্বপ্ন নয়, এটি একটি বাস্তবতা। আশা করা  হচ্ছে, আগামী বছরের প্রথমেই সেতুতে চলবে গাড়ি। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছেন, বিশ্বব্যাংককে বাদ দেওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব দিয়েছিলেন, কীভাবে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করা যায়। অর্থায়নের পরিকল্পনা নিয়ে তখন নানা পর্যায়ে কথা বললেও সংশয় ছিল পারব কিনা। আজ আর কোনো সংশয় নেই, পদ্মা সেতু হবেই। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামো খাতের এত বড় প্রকল্প নিজেদের টাকায় বাস্তবায়ন করতে পারা বাংলাদেশের জন্য গর্বের ব্যাপার। কারণ এটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রমাণ।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষকতা করা ড. এ কে আবদুল মোমেনের মতে, স্বাধীনতা ও মুক্তি দুটো ভিন্ন বিষয়। ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু অর্থনৈতিক-সামাজিক মুক্তির জন্য লড়াই চলছে। মুক্তি হলো বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার, যেখানে সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা নিশ্চিত হবে। যেখানে ধনী-দরিদ্রের আকাশসম ফারাক থাকবে না। প্রত্যেকের সমান সুযোগ-সুবিধা থাকবে। আইন সবার জন্য সমান হবে। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন। এটা আমাদেরও স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধু তার স্বল্পকালীন সরকারে অনেক কিছুই করেছেন, কিন্তু যে জিনিসটি করে তিনি আমাদের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন তা হচ্ছে, তার সোনার বাংলার স্বপ্ন। আমাদের মনন-মগজে সোনার বাংলার স্বপ্ন তিনি দিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটি বাস্তবায়নেই উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছেন। এক সময়ের সৌদি সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা এবং সর্বশেষ জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের কয়েকটি রোডম্যাপ দিয়েছেন। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে। আরও একটি ভিশন দিয়েছেন, ২০৪১ সালে আমরা একটি উন্নত-সমৃদ্ধিশালী-অসাম্প্রদায়িক-স্থিতিশীল অর্থনীতির দেশ হব।

তার মতে, অর্থনৈতিক মুক্তির পথ সহজ নয়। অর্জনে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। যেমন— দুর্বল অবকাঠামো, প্রশিক্ষিত উন্নত দক্ষ জনবলের অভাব, জ্বালানি সক্ষমতার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও সুশাসন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশন কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিক ক্রমতালিকা প্রকাশ করছে। সর্বশেষ গত মাসে প্রকাশিত তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্যে ১২৮ তম ও এশিয়ায় ৪১ দেশের মধ্যে ২৮তম। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশ প্রতি বছরই এই তালিকায় উপরের দিকে উঠে এসেছে এবং ভারত-পাকিস্তানের মতো দেশকে টপকেছে। এ তালিকায় যথাক্রমে ১৩০ এবং ১৩১তম অবস্থানে আছে ভারত ও পাকিস্তান। ২০১৭ সালেও বাংলাদেশ এবারের মতো ১২৮তম অবস্থানে থাকলেও পয়েন্ট বেড়েছে দশমিক তিন শতাংশ। কিন্তু ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৩৭তম স্থানে। সেখান থেকে এক বছরে ৯ ধাপ এগিয়ে ১২৮তম অবস্থানে আসে বাংলাদেশ। গবেষণা সংস্থাটির মতে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হচ্ছে ব্যবসায়িক পরিবেশের চেয়ে বেশি কিছু। অর্থাৎ এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা যেখানে উদ্যোক্তারা মুক্তভাবে তাদের কর্মকাণ্ড করতে পারবেন এবং দেশের অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে মানুষের ক্ষমতায়ন হবে এবং সর্বশ্রেণির মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচক তৈরিতে আইনের শাসন, সরকারি আয়-ব্যয়ের পরিমাণ, নিয়ন্ত্রণগত দক্ষতা এবং মুক্তবাজার— এ চারটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেকটিকে আবার তিনটি সূচকে মূল্যায়ন করে মোট ১২টি মাপকাঠির মাধ্যমে একটি দেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ১২টি মাপকাঠির মধ্যে আইনের শাসনের অধীনে রয়েছে সম্পদের অধিকার, বিচারিক কার্যকারিতা ও সরকারের শুদ্ধতা। সরকারি আয়-ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে করের বোঝা, সরকারি ব্যয় ও রাজস্ব অবস্থা। নিয়ন্ত্রণগত দক্ষতার মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়িক স্বাধীনতা, শ্রমিক অধিকার ও মুদ্রানীতির স্বাধীনতা। মুক্ত বাজারের মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যিক সুযোগ, বিনিয়োগ সুযোগ এবং আর্থিক সুযোগ। এসব বিষয়ে জানতে অর্থনীতি সমিতির সঙ্গে যুক্ত থাকা দেশের এক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪ মার্চের একটি ভাষণের অংশবিশেষ উল্লেখ করেন। দেশের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের উদ্দেশে ওসমানী মিলনায়তনে দেওয়া ওই ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি হয়েছে, কিন্তু শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের। আমরা এখন এই যুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রাম চালাচ্ছি। এই সংগ্রাম অনেক বেশি সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। তবে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থেকে কঠোর পরিশ্রম করি এবং সৎ পথে থাকি তবে, ইনশা আল্লাহ জয় আমাদের অনিবার্য।’ এ ভাষণকে অর্থনৈতিক মুক্তির সনদ বলেও আখ্যা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা ওই অর্থনীতিবিদ।

 

 

যেভাবে বদলাবে স্বর্ণদ্বীপ
আমেরিকা জয়ে বাংলাদেশিরা

সর্বশেষ খবর