সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইতিহাস বিকৃতি অপরাধ আইন এখনো খসড়ায়

আরাফাত মুন্না

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার ও বিকৃতি রোধে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি দুই বছরেও। আইন কমিশন আইনের খসড়া প্রণয়ন করে ২০১৬ সালের ২১ মার্চ আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দেশ-বিদেশে নানাভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এসব অপপ্রচার বন্ধে এই আইনটি এখন সময়ের দাবি। আইনটি প্রণীত হলে দেশি-বিদেশি কোনো ব্যক্তি প্রচার মাধ্যম, গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করে কিছু বললে ও লিখলে তাকে বিচারের আওতায় আনা যাবে। আইন লঙ্ঘনকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে। এ ছাড়া একই অপরাধ দ্বিতীয়বার করলে সাজা ও জরিমানাও দ্বিগুণ হবে বলে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের নামকরণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন’। আইনের খসড়াটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, খসড়া আইনে মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস অস্বীকার বা এর বিকৃতিকরণ করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমূহ অস্বীকার; মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম বা প্রচারমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান বা প্রচার; একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচারিত বা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত দলিলসমূহ এবং ওই সময়ের যে কোনো ধরনের প্রকাশনার অপব্যাখ্যা বা অবমূল্যায়ন করা এই আইনের আওতায় অপরাধ হবে। এ ছাড়া পাঠ্যপুস্তকসহ যে কোনো মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অসত্য, অর্ধসত্য, ভ্রান্ত বা বিভ্রান্তিকরভাবে উপস্থাপন; মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা বা জনগণকে হত্যা, ধর্ষণ ও তাদের সহায়সম্পত্তি লুটতরাজ বা অগ্নিসংযোগ-সংক্রান্ত যে কোনো তথ্যের অবনমন; মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত কোনো ঘটনা, তথ্য বা উপাত্ত ব্যঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন; মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভিন্ন অন্য কোনো রূপে অবনমন বা অবমাননাকেও অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে খসড়া আইনে।

আইনের খসড়ায় পাকিস্তানি দখলদার সশস্ত্রবাহিনী, তাদের বিভিন্ন সহায়ক বাহিনী যেমন : রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও শান্তি কমিটি ইত্যাদির বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের পক্ষে কোনো ধরনের যুক্তি প্রদর্শন বা প্রচারণা; মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন বা ওইরকম অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধকরণ বা এ বিষয়ে কোনো ধরনের অপপ্রচার অপরাধ বলে গণ্য হবে।

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের এক শ্রেণির মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে হেয় করেন। কেউ কেউ আছেন তারা এই যুদ্ধকেই অস্বীকার করেন। এ ছাড়াও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তারা আরও সক্রিয় হয়ে মহান স্বাধীনতার ঘটনা ও ইতিহাসের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালাতে থাকেন। সময়োপযোগিতা বিবেচনা করে আমরা এ ধরনের একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দেশ-বিদেশে নানাভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে। দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানাভাবে কথা বলে। তারা মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয় নিয়ে কটূক্তি ও মিথ্যাচার করে। প্রকারান্তরে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকেই অস্বীকার করে। এরকম চলতে থাকলে দেশ পথহারা হয়ে যাবে। এজন্য আইনটি প্রণয়ন বেশ জরুরি। এই আইনটি প্রণয়ন করা না হলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, আমাদের অনুরোধে আইন কমিশন আইনের খসড়া প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্ব সেই আইনটি পাস করা। কেন এখনো আইনটি পাস হয়নি সেটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন।

এদিকে আইনের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই আইনটির খসড়ার বিষয়ে আমিও শুনেছিলাম। তবে এর অগ্রগতি কি সেটা আমার জানা নেই। সম্ভবত আইন মন্ত্রণালয় আইনটি নিয়ে কাজ করছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই আইনটি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এখনো খসড়া চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। এটা ভেটিং (পর্যালোচনা) পর্যায়ে রয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষ হলেই খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় তোলা হবে।

আইন কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা (জেলা জজ) ফউজুল আজিম বলেন, খসড়া আইনটি প্রস্তুত করে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আইন মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই। আইনের খসড়া প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পরে আসলে আমাদের কোনো কাজ নেই। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ই সেই খসড়াটি চূড়ান্ত আইনে পরিণত করার বিষয়ে কাজ করে।

সর্বশেষ খবর