শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোটের বছরে কঠিন বাস্তবতা

দলের অভ্যন্তরীণ হানাহানি বিরোধ । উন্নয়ন ধারাবাহিকতা ধরে রাখা । আইনশৃঙ্খলা । দেশবিদেশের সম্পর্কের বন্ধন স্বাভাবিক রেখে এগিয়ে নেওয়া । জোটের আসন ভাগাভাগি

রফিকুল ইসলাম রনি

ভোটের বছরে কঠিন বাস্তবতা

যশোরের কেশবপুর ও সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ তুলেছে দলের স্থানীয় এমপিদের বিরুদ্ধে। গতকালও শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে মুক্তিযোদ্ধা জনতা মঞ্চে বদিউজ্জামান বাদশার নেতৃত্বে এমপির বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগের একাংশ। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, মাঠের আওয়ামী লীগ কথা বলতে শুরু করেছে এমপিদের বিরুদ্ধে। কেন এ অবস্থা? খোঁজ নিতে শুরু করেছেন দলের নীতিনির্ধারকরা।

এ চিত্র শুধু যশোর, শেরপুর, সিরাজগঞ্জে নয়, শতাধিক নির্বাচনী এলাকার। আগামী ভোটে প্রার্থী বদল না করলে এসব এলাকায় সমস্যা বাড়বে। ভোট ছাড়া নির্বাচন করার কারণে কিছু এমপি দল ও নেতা-কর্মীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন। ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ শুধু দল নয়, এর বাইরে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা নির্ধারিত সময়ে শেষ করা ও এগিয়ে নেওয়া। একই সঙ্গে দেশ-বিদেশে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল রাখা। পাশাপাশি গণমাধ্যম ও ব্যবসায়ী সমাজের সঙ্গেও দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন দূর ও স্বাভাবিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখা। দলের অনেক নেতাই বাস্তবতার মধ্যে নেই। সবকিছু একাই সামাল দিতে হচ্ছে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। আওয়ামী ঘরানার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দলে আরও নির্ভরশীল নেতা দরকার। কারণ নির্বাচনের সময় যে কাউকে দিয়ে সিভিল প্রশাসন, পুলিশ, গণমাধ্যম, ব্যবসায়ী ও সবকিছু সমন্বয় করা সম্ভব নয়। তাই সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে এখন থেকেই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে। এখন দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা, জনবিচ্ছিন্নতা ও চাটুকার পরিবেষ্টিত থাকার অভিযোগ তুলছেন তারা। এমন নেতা-এমপি-মন্ত্রীর তালিকা তৈরি করে আগামীতে বাদ দিতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন, নানাভাবে সমালোচিত হয়ে নিজেকে এবং দলকে হেয় করেছেন, এসব নেতার বিরুদ্ধেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একই সঙ্গে দেশব্যাপী নির্বাচনী ঢেউ তুলতে মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হবে। সরকারের যেসব চলমান ও গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে সেগুলোও নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন না করা গেলে সমস্যা বাড়বে। সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি কাটিয়ে গতি আনতে  হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। প্রথম মেয়াদের অসমাপ্ত কাজের পাশাপাশি সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে এসেও আরও বেশকিছু বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও বেশির ভাগই এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত বা চলমান। এগুলো যথাসময়ে শেষ করতে হবে। একাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশিদের সঙ্গে বর্তমান রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিল। এবার যেন ওই ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকারকে সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।

তবে এ মুহূর্তে সরকারের হাইকমান্ড মনে করছেন, তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে— এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সে ক্ষেত্রে এ নির্বাচন হবে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। কাজেই জনবিচ্ছিন্ন ও বিতর্কিতদের দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব হবে না। পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির প্রার্থীরা ভোটারদের সহানুভূতি আদায়ে তাদের ক্লিন ইমেজ কাজে লাগাবেন। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের এবারের ভরসা অপেক্ষাকৃত তরুণ, বঞ্চিত ও ত্যাগী নেতারা। এ ক্ষেত্রে তৃণমূলে পেছনের কাতারে থাকা সৎ, বঞ্চিত ও ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে জোটে করতে হবে আসন ভাগাভাগি। আগামী নির্বাচনে জোটের নেতারা বড় আবদার করবেন জোটপ্রধান আওয়ামী লীগের কাছে।

দল ও সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরপর তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা খুবই কঠিন। তবে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত নির্বাচনে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে এবং কতগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম সে বিষয়ে জনগণকে জানাতে হবে। আস্থা তৈরি করতে হবে। আওয়ামী লীগকে এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তা করতে হবে। সরকারের বর্তমান উন্নয়ন ও আগামীর ভিশন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে পারলে কোনো কিছুই কঠিন নয়।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু উন্নয়নের কথা বলে মানুষকে ভোটের দিকে টানা যাবে না। বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী বিশেষ করে বিনা ভোটে নির্বাচিত কিছু এমপি ঢাকায় চলে এসে শ্যালক, শ্বশুর, চাচাতো ভাই, মামাতো ভাইকে দায়িত্ব দিয়েছেন এলাকা দেখাশোনার। তারা এলাকায় দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার করেন। মানুষ উন্নয়নের চেয়ে ক্ষতিকেই বেশি মনে রাখে। যারা অপরাধ করেছেন, তাদের শাস্তি দিতেই হবে। তা না করলে আওয়ামী লীগকে ভোগান্তিতে পড়তে হবে। বড় বড় সমাবেশ করে উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি দলের অভ্যন্তরে ছোট ছোট সমস্যা স্থানীয়ভাবে বসে আগে মীমাংসা করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেদিকে যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বড় দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি। আগামী নির্বাচনের আগে দুর্বলতা কাটাতে না পারলে নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এ ছাড়া সুশীলসমাজ-গণমাধ্যমের সঙ্গে যেখানে যেখানে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে। কারও সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে স্থায়ীভাবে রাজনীতি করা যাবে না। এই কম সময়ের মধ্যেই আওয়ামী লীগকে তা করতে হবে।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশ-বিদেশ, বিরোধী দলসহ নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই সরকার দেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছে। আগামীতেও এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ব্যাংক নিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, আশা করি সেগুলো সমাধান হয়ে যাবে। ৩ এপ্রিল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে ডেকেছেন। ওইদিন তিনি দিকনির্দেশনা দেবেন।

পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কিছু কিছু সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো থাকে, আবার কখনো কখনো খারাপের দিকে যায়। পুলিশকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। এককভাবে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। এলাকার গণমান্য ব্যক্তি, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আর পুলিশকে অবশ্যই পেশাদারিত্বের মধ্যে থেকে কাজ করতে হবে। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে যারাই পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন, সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। আর যারাই নিজেদের পলিটিসাইজ করতে যাবেন, সেখানে বিপত্তি ঘটতে পারে। তিনি বলেন, আগামীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের সঙ্গে সব শ্রেণির মানুষের সহায়তা প্রয়োজন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশি সময় হাতে নেই ক্ষমতাসীনদের। এই সময়ের মধ্যেই সবকিছুর সামাল দিতে হবে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে রাখার পাশাপাশি অনেক কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করেই তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে হবে তাদের। সবকিছু করতে হবে বিচক্ষণতার সঙ্গেই।

সর্বশেষ খবর