নানান উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে নতুন শ্রমবাজার খুলছে না বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য। ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর দুয়ার এখনো বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বন্ধ। চলতি বছরে বিদেশগামী ১০ লাখ কর্মীর ৯০ শতাংশেরই গন্তব্য পুরনো বাজার মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে। তবে এর মধ্যে সৌদি আরবের নতুন নিয়ম, আমিরাতের ভিসা বন্ধ, কুয়েতের নতুন নিষেধাজ্ঞা, লিবিয়ার অস্থিরতা মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে দীর্ঘায়িত করেছে। শুধু মালয়েশিয়ায় সরকারি পর্যায়ে জিটুটি প্লাস পদ্ধতিতে কর্মী প্রেরণই এখন আশার আলো ছড়াচ্ছে। কিন্তু এই আশার আলোতে ঝামেলা তৈরি করছে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে ঢাকায় নতুন একটি কার্যালয় খুলে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (আইসিএস) দেওয়ার নতুন পদ্ধতি। জানা গেছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার, বিশ্বের অন্যতম বিত্তশালী ও সর্বাধিক তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিজস্ব তেলনির্ভরতা কমাতে এবং দেশের অর্থনীতির ক্রমোন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৬ সালের এপ্রিলে দেশটির মন্ত্রিসভায় ‘ভিশন-২০৩০’ নামে এক মহাপরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এতে বলা হয়েছে তেলনির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসা, প্রযুক্তি খাতে তরুণ নাগরিকদের কর্মসংস্থানে নতুন নতুন খাত তৈরি, নারীর ক্ষমতায়ন ও নাগরিকদের জীবনযাপনের ওপর কড়াকড়ি শিথিলের কথা। এরই ধারাবাহিকতায় ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়ন ও সৌদি নাগরিকদের কর্মসংস্থান বাড়াতে দেশটিতে মোবাইল ফোন সেট, বোরকার দোকান, রেন্ট-এ-কার, অ্যাকাউন্টিং, নারীদের তৈরি পোশাকের দোকান, চশমা, ঘড়ি, বাড়ি বা গৃহনির্মাণসামগ্রী, গাড়ির যন্ত্রাংশ, গাড়ির শোরুম, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ও বিদ্যুৎ-চালিত সামগ্রী, হাসপাতালে ব্যবহূত সরঞ্জাম, চকলেট বা মিষ্টান্নের দোকান, রেডিমেড কাপড়ের দোকান, ক্রোকারিজ-সামগ্রী, কার্পেট, ফার্নিচার বা ডেকোরেশন, শপিং মল, গার্লস স্কুল, ভারী যানবাহন, ক্রেন চালনা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে প্রবাসীদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়। এর বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদগুলোয় সৌদি নাগরিক নিয়োগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়; যার ফলে অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সেক্রেটারি, সেল্সম্যান, অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, সেল্স ম্যানেজার, সেল্স সুপারভাইজার, ফাইন্যান্স ম্যানেজার, চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সিনিয়র অ্যাকাউন্ট্যান্ট, অফিস ম্যানেজার, সেল্স অ্যাসিস্ট্যান্স, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ম্যানেজার, অফিস বয়, ড্রাইভার, রিসিপশনিস্ট, ওয়ারহাউস ম্যানেজার, ফোর্কলিফট অপারেটর, লজিস্টিক সুপারভাইজার পেশায় নিয়োজিত প্রবাসীরাও চাকরি হারাচ্ছেন। সৌদি সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশটিতে প্রবাসীদের শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সিঙ্গাপুর থেকে ২৬ শ্রমিককে দেশে ফেরত পাঠানোর পর সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিরা বেশ আতঙ্কিত। জানা গেছে, নির্মাণ ও জাহাজশিল্পে বাংলাদেশি শ্রমিকের বিপরীতে ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে শ্রমিক নিচ্ছে সিঙ্গাপুর।
জনশক্তি রপ্তানির এই জটিল অবস্থায় ভরসা শুধু মালয়েশিয়া, দুই সরকারের চুক্তির ধারাবাহিকতা। সেখানেও নানামুখী প্রতিবন্ধকতা লেগেই রয়েছে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার মহাসচিব রূহুল আমিন স্বপন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইতিমধ্যেই মালয়েশিয়া থেকে ২ লাখের বেশি ডিমান্ড লেটার এসেছে। এর মধ্যে ১ লাখ ১২ হাজারের বেশি শ্রমিক চলেও গেছে। যাওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও ৬০ হাজার। আশা করছি বছরে ৩ লাখ শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হবে।’ তার মুখে আশার আলো থাকলেও বিদেশ গমনেচ্ছুদের অভিযোগ, মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্রে ঢাকায় নতুন একটি কার্যালয় খুলে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (আইসিএস) দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেছে নতুন একটি বিদেশি কোম্পানি। শ্রমিকদের মেডিকেল টেস্টসহ ভিসার অন্যান্য কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই এ কার্যালয় থেকে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের নামে নেওয়া হচ্ছে ৩ হাজার ৪৫ টাকা। সরকার যখন অভিবাসন ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে তখন এ ধরনের অননুমোদিত অর্থ আদায় নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গতকাল গুলশানে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট (আইসিএস) কার্যালয়ে গিয়ে তাদের নতুন এই কার্যক্রমের সম্পর্কে জানতে চাইলে দায়িত্বশীলদের কেউ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। তবে এক কর্মকর্তা দাবি করেন, উভয় দেশের সম্মতিতেই নতুন এ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে একজন শ্রমিকের ভিসা প্রদান এবং অন্যান্য কাগজপত্র চূড়ান্ত হওয়ার আগে এই অর্থ প্রদানের নতুন নিয়মে বিস্ময় তৈরি হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বায়রা মহাসচিব রূহুল আমিন স্বপন বলেন, বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার জিটুজি যে কার্যপ্রণালি তাতে কোথাও এ ধরনের কোনো ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিয়ে অর্থ আদায়ের কথা বলা নেই। মেডিকেল টেস্ট বা ভিসার আগে শ্রমিকদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের কোনো ব্যবস্থা থাকতেই পারে না উল্লেখ করে এই জনশক্তি রপ্তানিকারক বলেন, এটা এক ধরনের ক্রিমিন্যাল অফেন্স হতে পারে। কারণ, যে শ্রমিক মেডিকেল টেস্টে বাদ পড়তে পারে তার কাছ থেকে আগেই ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের অর্থ আদায় কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। জনশক্তি খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের একমাত্র আশার আলো হয়ে থাকা মালয়েশিয়ার জিটুজি পদ্ধতি ঘিরে নানান ষড়যন্ত্র আগেও হয়েছে। এখনো হচ্ছে। নতুন এই ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটকে দালালচক্র সাধারণ খেটে খাওয়া অর্ধশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষের কাছে ভিসা হিসেবে চালিয়ে দিতে পারে। তখন প্রতারণার সংখ্যাও বাড়বে অনেক বেশি। এতে শ্রমিকরা প্রতারিতও হতে পারেন। তাই দ্রুত প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় হতে হবে।