বৃহস্পতিবার, ২৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

কম সুদের দিন শেষ

বিশ্বব্যাংকের ঋণের শর্ত কঠিন হচ্ছে জুলাই থেকে, কমছে রেয়াতকাল পরিশোধের সময়ও, জাইকার ঋণের সুদের হারও বাড়ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী জুলাই থেকে বাংলাদেশের জন্য কম সুদের ঋণ বন্ধ করে দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। পাশাপাশি এই সংস্থা মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ায় সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও গুনতে হবে বাড়তি চাঁদা। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিন বছর ধারাবাহিকভাবে মাথাপিছু জাতীয় আয় বিশ্বব্যাংকের দেওয়া শর্তের আলোকে অর্জন করায় নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আগামী ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশের এই মধুর যন্ত্রণা শুরু হতে যাচ্ছে। সংস্থাটির মূল্যায়নে ১৯৭২ সালে সদস্য হওয়ার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিম্ন আয়ের দেশ ছিল বাংলাদেশ। সে কারণে এদ্দিন স্বল্প সুদে ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ যেহেতু নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং পরপর তিন বছর ধারাবাহিকভাবে জাতীয় আয় বেড়েছে; তাই কম সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আর নেই। জুলাই থেকে কঠিন শর্তেই ঋণ নিতে হবে বাংলাদেশকে। সে ঋণের সুদহার ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে, যা এখন শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ১ জুলাই থেকে ‘গ্যাপ কান্ট্রি’ হিসেবে পরিচিত হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে এসব জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) ঋণের সুদহারও বাড়ানো হচ্ছে। ৩৯তম ইয়েন লোন প্যাকেজের আওতায় সংস্থাটি বাংলাদেশকে যে ঋণ দেবে, তার সুদের হার হবে ১ শতাংশ যা এখন শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশে আছে। বহুজাতিক বিশ্বব্যাংক তাদের মূলধন বাড়াতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, সেসব খাতে ঋণ বাড়াতে মূলধন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। মূলধনের আকার ১০ হাজার কোটি ডলার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ টাকা ওঠানো হবে বিশ্বব্যাংকের ১৮৯টি সদস্যরাষ্ট্র থেকে। বিশ্বব্যাংকে যার শেয়ার যত বেশি, ওই দেশের চাঁদার হারও বেশি। সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশকেও বাড়তি চাঁদা দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও শরণার্থীদের আশ্রয়ে বাড়তি এ টাকা বিনিয়োগ হবে। ৯৬ পৃষ্ঠার এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০ এপ্রিল ওয়াশিংটনে শুরু হওয়া বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বসন্তকালীন অধিবেশনে মূলধন বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১০ সালে শেষবারের মতো মূলধন বাড়িয়েছিল বিশ্বব্যাংক। ওইসময়কার প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের আমলে বিশ্বমন্দা থেকে রক্ষা পেতে ৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলার মূলধন বাড়ানো হয়েছিল। জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। পরপর তিন বছর বাংলাদেশ জাতীয় মাথাপিছু আয় ধারাবাহিকভাবে ধরে রেখেছে। সে কারণে বিশ্বব্যাংক থেকে এত বছর সহজ শর্তে যে ঋণ পাওয়া যেত, তা জুলাই থেকে আর পাওয়া যাবে না। সুদের হার বাড়বে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক বিশ্বব্যাপী তাদের ঋণের পরিমাণ বাড়াতে চায়। সে কারণে তারা মূলধন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মূলধন বাড়লে বাংলাদেশের জন্য বেশি করে ঋণ পাওয়ার পথ সুগম হবে বলে জানান শফিকুল আযম।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিম্ন আয়ের দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ এদ্দিন বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেত। এ ঋণের সার্ভিস চার্জ শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা ঋণ নিলে সুদের হার ৭৫ পয়সা। জুলাই থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে যে ঋণ নেওয়া হবে, তার সুদের হার ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ ১০০ টাকা ঋণ নিলে সে ঋণের সুদহার হবে ২ টাকা। বিশ্বব্যাংক সূত্র বলছে, আগামী জুলাই থেকে ডলারে ঋণ নিলে ঋণের সুদহার হবে ২ শতাংশ। আর বর্তমান যে পদ্ধতিতে স্পেশাল ড্রইং রাইটে (এসডিআর) বাংলাদেশ আইডিএ ঋণ নেয়, সে আলোকে নিলে ঋণের সুদহার হবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ।

এ ছাড়া ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কমে যাচ্ছে আগামী জুলাই থেকে। কোনো প্রকল্পে ঋণচুক্তি করলে সে ঋণ ৩০ বছরে পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। বর্তমানে এ সময়সীমা ৩৮ বছর। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ যে গ্রেস পিরিয়ড বা রেয়াতকাল পায়, সে সময়সীমাও কমছে। এখন চুক্তির পর প্রথম ছয় বছর ঋণের সুদহার দিতে হয় না। এটি কমে পাঁচ বছরে নেমে আসছে। সুদের হার বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়বে উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর। চাপ পড়বে বাজেটের ওপরও। কারণ, বাজেটে সুদ পরিশোধে বাড়তি টাকা রাখতে হবে সরকারকে। জানতে চাইলে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ আইডিএ থেকে এদ্দিন সহজ শর্তে ঋণ পেত। জুলাই থেকে ঋণের সুদহার বাড়বে। কারণ, বিশ্বব্যাংকের এটলাস পদ্ধতিতে কোনো দেশের ধারাবাহিকভাবে তিন বছর ১১৬৫ ডলারের বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে ওই দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে তিন বছর ১১৬৫ ডলারের বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় অর্জিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এটলাস পদ্ধতির হিসাবে এটি এখন ১৪৯৬ ডলার। তাই জুলাই থেকে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিশ্বব্যাংক তাদের মূলধন বাড়ালে বাংলাদেশকে চাঁদাও বেশি দিতে হবে। এতে একদিকে যেমন বাজেটে বাড়তি টাকা রাখতে হবে, আবার বাংলাদেশ বাড়তি ঋণও পাবে। এতে নতুন সুযোগও তৈরি হবে। ইআরডি সূত্র বলছে, বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশে এখন শেয়ার আছে ৬ হাজার ২১৮টি, যা বিশ্বব্যাংকের মোট শেয়ারের প্রায় শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের মূল্য ধরা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার। সে আলোকে বাংলাদেশকে চাঁদা গুনতে হবে। তবে মূলধনের আকার যেহেতু এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তাই বাংলাদেশকে বছরে কত টাকা পরিশোধ করা হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের নতুন এই প্রস্তাবের ওপর মতামত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে ইআরডি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বসন্তকালীন বৈঠকে আলোচনা করবে সরকার। ২০ এপ্রিল ওয়াশিংটনে শুরু হচ্ছে বসন্তকালীন বৈঠক। ওই বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযমসহ সরকারের বেশ কয়েকজন নীতিনির্ধারক যোগ দেবেন। ইআরডি সূত্র বলছে, ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক একটি সমবায়ের মতো। সদস্যরাই এর হিস্সাদার বা শেয়ারহোল্ডার। দেশের অর্থনীতির আকারের ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট দেশ তার হিস্সা বা শেয়ার পায়। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় একক হিস্সাদার। বিশ্বব্যাংকে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার আছে প্রায় ১৬ শতাংশ। পাঁচ বৃহত্তম হিস্সাদারের মধ্যে অন্য চারটি হলো— ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান ও যুক্তরাজ্য। নতুন করে যোগ হয়েছে চীন। সম্প্রতি যোগ হওয়া আফ্রিকাসহ বিশ্বব্যাংকে ২৫ জন নির্বাহী পরিচালক রয়েছেন। এসব নির্বাহী পরিচালকের সমন্বয়ে গঠিত হয় বিশ্বব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ড অব গভর্নরস। এ বোর্ড ব্যাংকের নীতি নির্ধারণ ও কর্ম পরিচালনা তদারকি করে। সরকারের সাবেক সচিব আরাস্তু খান মনে করেন, মূলধন বাড়লে তা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। তখন বিভিন্ন খাতে বাড়তি ঋণ পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণের পরিধি বাড়াতে এ উদ্যোগ নিয়েছে।

ইআরডির অতিরিক্ত সচিব শহিদুল ইসলাম বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ঘোষণা আসার পর থেকে জাইকা তাদের ঋণের সুদহার বাড়াচ্ছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির ঋণের সুদহার ছিল শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। পরের বছর তা বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৭৫ করা হয়েছে। এখন তা ১ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব এসেছে। আসছে ৩৯তম ইয়েন লোন প্যাকেজের আওতায় নতুন ঋণের সুদহার কার্যকর হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর