বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আমানুল্লাহ। হঠাৎ সেই প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা প্রচণ্ড খারাপের দিকে যায়। অর্থ সংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। দুই মাস ধরে স্টাফরা বেতন পাচ্ছেন না। ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েন আমানুল্লাহ। বাড়ি ভাড়া, বাচ্চার স্কুলের বেতন, পরিবারের খরচ—সব মিলিয়ে একটা বড় ধরনের সমস্যায় পড়েন তিনি। কীভাবে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব যারা ছিলেন ইতিমধ্যে সবার কাছ থেকেই ধার-দেনা করে ফেলেছেন। এখন আর কোনো বন্ধু বাকি নেই। দ্বিতীয়বার কারও কাছ থেকে আর ধারও পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে তার ছোট্ট মেয়েটি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার দেখাবেন, সেই অবস্থাও আর নেই। টঙ্গী থেকে বাসে চড়ে প্রতিদিন সকালে বনানীর অফিসে আসেন। কোনো কাজ নেই অফিসে। বেতনের জন্য অ্যাকাউন্টস অফিসারের কাছে ধরনা দেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। বাচ্চা অসুস্থ জেনেও অফিস থেকে কোনো সাহায্য পাচ্ছেন না। অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েন অজানা উদ্দেশ্যে। রাতে ফেরেন। বাসায় স্ত্রী আর একমাত্র সন্তান কি খাচ্ছে না খাচ্ছে, সেই খোঁজও নিতে পারেন না তিনি। প্রতিদিন বাসা থেকে বেরোনোর আগে স্ত্রীকে বলেন, ‘চিন্তা করো না। আজ টাকা জোগাড় হবে। আমি ফোন দিলেই বিউটিকে নিয়ে চলে আসবা। ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। মেয়ে আমার অনেক কষ্ট পাচ্ছে।’ স্ত্রীও মাথা নেড়ে সায় দেন। বলেন, প্রতিদিনই তুমি বলে যাও, ফোনতো দাও না। সেই অনেক রাতে বাসায় ফিরো।’ মাথা নিচু করে বেরিয়ে যান আমানুল্লাহ। কিছু বলতে পারেন না। সেদিনও একই কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যান আমানুল্লাহ। টঙ্গী থেকে বাসে চড়ে আমানুল্লাহ ভাবছিলেন আজ আর অফিসে যাবে না। খামখা গিয়ে কী হবে। তার চেয়ে ভালো, ছোট বেলার বন্ধু সোয়েবের কাছেই আবারও যাই। দেখি ও কোনো টাকার ব্যবস্থা করতে পারে কিনা। পুরান ঢাকায় তার বন্ধু সোয়েবের বাসায় যান আমানুল্লাহ। সোয়েবের কাছে বলে, দোস্ত মেয়েটা অসুস্থ। আমাকে আরও কিছু টাকা দে। বেতন পেলে আগের টাকাসহ ফেরত দিব। এ কথা শুনে সোয়েব বিরক্ত হয়। বলেন, আমি আর কীভাবে দেব। আগের টাকাই তো ফেরত দিলি না। আমি ভাবছি তুই টাকা নিয়ে এসেছিস। এখন উল্টো টাকা চাচ্ছিস। আমার কাছে টাকা নেই। মন খারাপ করে বেরিয়ে পড়ে আমানুল্লাহ। ভিক্টোরিয়া পার্ক গিয়ে বসে থাকেন। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে, টের পায়নি আমানুল্লাহ। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। অফিসের ফোন। কী ব্যাপার! অফিসের ফোন কেন? ফোনের ওপাশ থেকে অ্যাকাউন্টস অফিসার তাকে বলল, আমানুল্লাহ সাহেব, আপনি একটু অফিসে আসবেন সময় করে। এমডি সাহেব শুনেছেন আপনার মেয়ে অসুস্থ। তাই এক মাসের বেতন আপনার জন্য রাখা আছে। নিয়ে যাবেন। আমানুল্লাহ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। আবারও জিজ্ঞাস করে কনফার্ম করলেন। পুরান ঢাকা থেকে বনানীর অফিস যেতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। অ্যাকাউন্টস কর্মকর্তা তখন বাইরে। অপেক্ষা করছেন তার জন্য। রাতে অ্যাকাউন্টস অফিসার আসার পর তিনি বেতন তুলেন। আমানুল্লাহর মুখে অনেকদিন পর হাসি ফুটল। টাকা পেয়েই স্ত্রীকে ফোন দিল আমানুল্লাহ। এই শুনছো, রেডি থেকো। রাত হয়ে গেছে। এরপরেও ডাক্তারকে পাওয়া যাবে। আমি আসতেছি বাসায়। ফোন পেয়ে স্ত্রী খুব খুশি। মেয়েকে নিয়ে আজ তারা ডাক্তারের কাছে যাবে। আট বছরের মেয়ে বিউটিও শুনে খুব খুশি। টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন আমানুল্লাহ। বনানী কবরস্থানের রাস্তা দিয়ে মূল সড়কে হেঁটে আসেন তিনি। রাস্তা পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাকলীর দিকে যাচ্ছেন। কিন্তু যানবাহন খুব একটা চোখে পড়ছে না। শুধু মানুষ আর মানুষ সেখানে। এমন সময় একটি মাইক্রোবাস এসে থামে তার সামনে। ভিতর থেকে একজন টঙ্গী টঙ্গী বলে ডাকছিলেন। দুজন লোক তাড়াহুড়ো করে মাইক্রোবাসে চড়ে বসল। তাদের দেখাদেখি আমানুল্লাহও। আমানুল্লাহ ভাবছেন, যাক তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। ভাগ্যটা তার ভালো। মাইক্রোবাসটি একটু সামান্য যাওয়া মাত্রই পেছনের সিট থেকে একজন তার কাঁধে হাত রেখে বলে, কি ভাই ভালো আছেন। খামাখা চিৎকার চেঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই। যা কিছু আছে বের করে দিলেই আমরা খুশি। এ কথা শুনে পাশের লোকের দিকে তাকিয়ে আমানুল্লাহ বলেন, দেখেছেন ভাই আমাকে কী বলছে এই লোকটা। কিন্তু যাকে বলছে সেই লোকটিও যে একই দলের সদস্য সেটা বুঝতে পারল তার কথাতে। লোকটি উল্টো বলল, যা বলছে, ঠিক মতো দিয়ে দে। নইলে গলা কেটে ফেলব। এ কথা বলেই লোকটি একটা চাপাতি দেখায় আমানুল্লাকে। তিনি বুঝতে পারেন, ছিনতাইকারী চক্রের মাইক্রোবাসে চড়ে বসেছেন তিনি। মাইক্রোবাসের যাত্রীবেশী ছিনতাইকারীরা তাকে মারধর করতে থাকে। পকেট থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়। ছিনিয়ে নেয় মোবাইল ফোনটাও। আমানুল্লাহ কাঁদতে থাকে। সবার পায়ে ধরে বলে, ভাই আমার মেয়েকে ডাক্তার দেখাব। কিন্তু কারও মন গলেনি। ভারী কোনো কিছু দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে আমানুল্লাহর মাথা দিয়ে। ছিনতাইকারীরা বলে— যা, আগে তোকে ডাক্তার দেখা। এ কথা বলেই তাকে মাইক্রোবাস থেকে ফেলে দেয়। আমানুল্লাহ দেখতে পান, তিনি খিলক্ষেতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। লোকজন এগিয়ে আসে। মাইক্রোবাস ততক্ষণে হাওয়া। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে বাসায় যখন ফিরে তখন মধ্যরাত। আমানুল্লাহ ভাবে, রাতে তার এভাবে মাইক্রোবাসে চড়ে বসাটা ঠিক হয়নি। অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে আমানুল্লাহ কোথায় যাবে আর ভেবে পাচ্ছিলেন না। আমানুল্লাহর ঘটনাটি কয়েকদিন আগের। কিন্তু এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে রাতের শহরে। শুধু ঢাকা নয়, দেশের প্রধান শহরগুলোর রাতের রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর চক্র। যারা রাতের গাড়ি পার্টি নামে পরিচিত। সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাজধানীতে কর্মব্যস্ত মানুষের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর অন্যতম সমস্যা হলো যানবাহনের স্বল্পতা। আর এই সমস্যাকে কাজে লাগিয়ে নগরীতে ছিনতাইয়ের ফাঁদ পাতছে বেশ কিছু সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। মাইক্রোবাসে যাত্রী পরিবহনের নামে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে এই ছিনতাইকারী চক্র। একটু আরামে ও দ্রুত অফিস বা গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়ায় অনেকটা অসাবধানতার কারণে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন যাত্রীরা। তবে পুলিশ বলছে আগের তুলনায় এ ধরনের ছিনতাইয়ের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। নগরীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে অফিসের শুরুতে বা শেষে হাজারো মানুষকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়। পাবলিক পরিবহনের আশায় অপেক্ষা করতে হয় তাদের। গন্তব্যে পৌঁছাতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় ছিনতাইকারীরা। অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সামনে মাইক্রোবাস নিয়ে ডাকাডাকি শুরু করে তারা। মাইক্রোবাসে লোক তোলা হয় টার্গেট করে। নির্ধারিত ব্যক্তি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় মাইক্রোবাস। ছেড়ে যায় গন্তব্যের পথে। মাঝ পথে গিয়ে টের পাওয়া যায়, টার্গেট ব্যক্তি ছাড়া বাকি সবার ভয়ঙ্কর রূপ বেরিয়ে আসে। প্রথমেই টার্গেট ব্যক্তিকে দুই পাশ থেকে দুজন শক্ত করে ধরে বসে। পেছন থেকে বা পাশ থেকে আরেকজন মুখ চেপে ধরে। কাউকে মারধর, কারও চোখে বিষাক্ত মলম ও মরিচের গুঁড়া জাতীয় পাউডার মেখে দেয়। এতে টার্গেট ব্যক্তির চোখে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, অনেকটা বেহুশ হওয়ার মতো অবস্থা। একই সঙ্গে চলে শারীরিক নির্যাতন। ছোট ছোট রড জাতীয় বস্তু বা হাতুড়ি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড়ে ও জয়েন্টে আঘাত করা হয়। এরপর কেড়ে নেওয়া হয় সঙ্গে থাকা মোবাইল, মানিব্যাগ, ল্যাপটপ সবকিছু। এ ছাড়া সঙ্গে থাকলে এটিএম কার্ড ও মোবাইল ব্যাংক থেকে টাকাও তুলে নেয় সংঘবদ্ধ চক্র। এরপর সুযোগ বোঝে মাইক্রোবাস থেকে ভুক্তভোগীকে নামিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। রাজধানীর বনানী, মহাখালী, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, মতিঝিল, নিউমার্কেট এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। এরা ছিনতাইয়ের কাজে বেশিরভাগ সময় কালো কাচের মাইক্রোবাস ব্যবহার করে। যাতে গাড়ির ভিতরে কী হচ্ছে বাইরে থেকে দেখা না যায়। পথচারীরা এ ধরনের ঘটনার শিকার হলেও ঝামেলা এড়াতে থানায় কোনো মামলা করা হয় না বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। মতিঝিল এলাকায় মাইক্রোবাসে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া ব্যবসায়ী কাঁকন মাহমুদ জানান, তিনি রাতে অফিস শেষে বাসায় ফেরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বাস না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে একটি মাইক্রোতে ওঠেন। কিছুদূর যাওয়ার পর শুরু হয় আক্রমণ। তাকে মারধর করে কেড়ে নেওয়া হয় সঙ্গে থাকা সবকিছু। এমনকি এটিএম কার্ডটিও নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। তবে পাসওয়ার্ড ভুল দেওয়ায় কোনো টাকা উত্তোলন করতে পারেনি দুর্বৃত্তরা। এ ব্যাপারে কোনো মামলা বা জিডি করেননি তিনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা এ ধরনের ছিনতাইকারী চক্রকে গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত রেখেছি। ইতিমধ্যে কিছু গ্রেফতারও হয়েছে। এখন অনেকটাই কমে গেছে পুলিশের টহলের কারণে। তিনি যাত্রীদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এসব ছিনতাই ঠেকাতে সবার আগে যাত্রীদের সচেতন হতে হবে। যে কোনো অপরিচিত মাইক্রোবাসে ওঠা যাবে না। কষ্ট হলেও পাবলিক পরিবহন যাতায়াতের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ।