শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
ভোটের আগে জোটের সমস্যা

ঢাল তলোয়ার নেই তবুও হতে চায় নৌকার মাঝি

জাতীয় পার্টি লাঙ্গলেই থাকবে

রফিকুল ইসলাম রনি ও শফিকুল ইসলাম সোহাগ

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে বর্তমানে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ১৩টি। এদের দুই-তিনটি ছাড়া অন্য কোনো দলের কার্যক্রম ঘরোয়া অনুষ্ঠানে জোরালো বক্তব্য দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।  জেলা-উপজেলায় কার্যালয় ও সাংগঠনিক ভিত্তি নেই তাদের। ছোট দলের বড় নেতার নিজ এলাকাতেও কখনোই সভা-সমাবেশ হয়নি। নেই সেই এলাকায় একজন কর্মী। অথচ তারা সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মুখিয়ে আছেন নৌকা পেতে। এ যেন ঢাল-তলোয়ার না থাকলেও নিধিরাম সর্দার। জোটের অধিকাংশ নেতাই ভাবছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনও হবে ২০১৪ সালের মতোই। কোনো মতে দর কষাকষি করে নৌকার মাঝি হতে পারলেই এমপি হয়ে সংসদে আসা যাবে। আবার কেউ কেউ এখন থেকে সংরক্ষিত আসনে যেন তাদের একজন প্রতিনিধি থাকে সেই দেনদরবারও করছেন ভেতরে ভেতরে। আর সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ক্ষমতার সঙ্গেই থাকতে চান।  সূত্র মতে, ক্ষমতাসীন জোটে আওয়ামী লীগ ছাড়াও রয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (ইনু), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ (আম্বিয়া), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ (মোজাফফর),  সাম্যবাদী দল, গণতন্ত্রী পার্টি, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি-জেপি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ ও বাসদ (একাংশ)। এগুলোর মধ্যে  হাতে গোনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্য কারো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। ঢাকাতেও একের বেশি কার্যালয় ও শাখা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু জোটের ভোটে ভাগ বসাতে চায় সবাই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেরি থাকলেও তারা ভেতরে ভেতরে সংসদীয় আসনে ভাগ নিতে দরকষাকষিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। জানা গেছে, বর্তমানে যেসব আসনে জোটের এমপি রয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় দফায় দফায় সংঘর্ষ এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এসব আসনে দল ক্ষমতায় কিন্তু ‘পরবাসী নেতা-কর্মীরা’ ক্ষোভে ফুঁসে উঠছেন। এ আসনগুলোয় আগামীতে ছাড় দিতে নারাজ স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এতে করে দল সাংগঠনিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটে নাই-জোটে আছে এমন নেতাদের ব্যাপারে দেখে শুনে আসন ছেড়ে দিতে হবে। জোটের কারণে আসন ছেড়ে দিলেও পাস করাতে ঘাম ঝরাতে হয় আওয়ামী লীগকে। কারণ ওইসব নেতাদের নিজ এলাকায় সাংগঠনিক শক্তি নেই। এমনকি স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনগুলোতেও কেউ কেউ প্রার্থীই দিতে পারেননি। আবার দু-একটি রাজনৈতিক দল প্রার্থী দিলেও জামানত হারাতে হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অবশ্যই জোটের ছোট দলের বড় নেতাকে মূল্যায়ন করতে হবে। তবে ঢাল-তলোয়ারবিহীন নেতাদের নৌকায় উঠিয়ে এমপি বানানো ঠিক হবে না। সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতামলে বিভিন্ন সময় শরিকরা নানা সুযোগ-সুবিধা গ্রহণে তৎপর ছিল। এসব রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা-বিবৃতি ছাড়া তাদের অন্য কিছু করারও নেই। কারণ, রাজপথে ভূমিকা পালন করার মতো সাংগঠনিক ভিতই নেই এ দলগুলোর। তাদের দলীয় কার্যক্রম অনেকটা এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক। শুধু জোট-মহাজোটের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ মেলাতে নামসর্বস্ব কিছু রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বাড়ানো হয় জোটের পরিধি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হিসাব মেলাতে শুরু করেছেন তারা।

ক্ষমতার সঙ্গেই থাকতে চান এইচ এম এরশাদ : আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট না হওয়ায় এবারও নির্বাচনী রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় পার্টির ভূমিকা হবে একরকম, আর অংশ না নিলে হবে আরেক রকম। বরাবরের মতো ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গেই থাকছেন এরশাদ।

জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগামীতে এইচ এম এরশাদ ও জাতীয় পার্টিকে উপেক্ষা করে কেউ ক্ষমতায় যেতে পারবে না। জাতীয় পার্টি কতটা শক্তিশালী তা রংপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে এক লাখ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়াও সুন্দরগঞ্জ উপনির্বাচনে বিজয় এবং ২৪ মার্চের মহাসমাবেশ প্রমাণ করে আমরা বর্তমানে কতটা শক্তিশালী। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টিকে উপেক্ষা করার শক্তি কারও নেই। ক্ষমতায় যাওয়া আমাদের টার্গেট। জাতীয় পার্টির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, আগামী সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা এখনো স্থির করা হয়নি। তবে যারাই সরকার গঠন করুক, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে এরশাদ নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। জাপার সভাপতিমণ্ডলীর একাধিক সদস্য জানান, সরকারের সমালোচনা করে এরশাদের বক্তব্য দেওয়া, মন্ত্রিসভা ত্যাগের হুমকি, আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে একক প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা— সবই  তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। বিএনপি নির্বাচনে না এলে এককভাবে নির্বাচন করবে জাতীয় পার্টি। আর বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে জোটগতভাবে আওয়ামী লীগের কাছে ১০০ আসন চাইবে দলটি। জানতে চাইলে পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের লক্ষ্য জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় নেওয়া। এ লক্ষ্য নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আমরা কাজ করছি।  দলীয় নেতারা জানান, দুই প্রধান দলের যে দলই ক্ষমতায় যেতে চাইবে, তাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সমর্থন প্রয়োজন হবে। ভোটের রাজনীতির নানা সমীকরণ বিবেচনায় তারা বলছেন, এরশাদ যেদিকে, ক্ষমতাও সেদিকে ঝুঁকবে। শুধু তা-ই নয় নির্বাচনকালীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকবে জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া নির্বাচন পরবর্তী যে দল সরকার গঠন করবে, সেখানে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাদের মতে, এ বাস্তবতায় জাতীয় পার্টির সমর্থন পেতে পর্দার আড়ালে অনেক কিছুই হচ্ছে। নেতারা মনে করেন, তিন কারণে এরশাদের সমর্থন ছাড়া কোনো দলের পক্ষে সরকার গঠন সম্ভব হবে না। প্রথমত, প্রতিটি নির্বাচনী আসনে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোট আছে জাতীয় পার্টির। এ ভোটের ব্যবধানে যেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারণ হবে, সেখানে জাতীয় পার্টির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের আগে এরশাদ কোনো দলকে সমর্থন দেয়ার পর ভোটের মাঠে এক ধরনের আগাম ফলাফল চিত্র ফুটে উঠবে। তৃতীয়ত, এরশাদ যে দলকে সমর্থন দেবেন, সেই দলের বিরুদ্ধে প্রশাসনের লোকজন হার্ডলাইনে যাওয়ার সাহস দেখাবে না। কারণ তারাও পরিস্থিতি ও ফল কী হতে যাচ্ছে, তা আঁচ করতে পারবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর