শুক্রবার, ৪ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভোটে গ্রেফতার আতঙ্ক বিএনপিতে

খুলনায় আটক ২১, প্রতিবাদে সকালে প্রচারণা বন্ধ দুপুরে ফের শুরু, কেএমপি কমিশনার ও গাজীপুরের এসপির বিরুদ্ধে নালিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা, খুলনা ও গাজীপুর প্রতিনিধি

উৎসবের ভোট নিয়ে আতঙ্কে বিএনপি। দুই সিটিতে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার আর প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ দলটির। এ অভিযোগ নিয়ে গতকাল সকালে চার ঘণ্টা প্রচারণা বন্ধও রাখেন খুলনা সিটি করপোরেশনে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। একই অভিযোগ গাজীপুর সিটিতে বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারেরও। তবে যত প্রতিকূলতাই থাকুক, নির্বাচন বর্জন করা যাবে না বলেও প্রার্থীদের কঠোর বার্তা দিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। ভোটের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত মাঠে থাকতে নেতা-কর্মীদের দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুই সিটি নির্বাচনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। গাজীপুরে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা টিম গঠন করা হয়েছে। একইভাবে খুলনায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে পৃথক আরেকটি টিম কাজ করছে। এ ছাড়া ২০-দলীয় জোটের শরিক দল ও স্থানীয়ভাবেও পৃথক কমিটি করে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী। ঢাকা থেকে নিয়মিত গাজীপুরে যাচ্ছেন বিএনপির একঝাঁক কেন্দ্রীয় নেতা।

গাজীপুর সিটি নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন স্বাধীন হলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নির্বাচন পরিচালনা করেন প্রশাসনের ব্যক্তিরা। প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ না হয় এবং নির্বাচন কমিশন যদি প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ না করে সরকার নিয়ন্ত্রণ করে তবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন না। বিএনপি আগে থেকেই এমন আশঙ্কা করছে। খুলনা সিটি নির্বাচনে হঠাৎ করে বিএনপির ২১ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার ও এ ঘটনায় দলের নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রম

সাময়িক বন্ধ ঘোষণায় বাড়তি উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সকাল ৯টার দিকে সব ধরনের প্রচার স্থগিত রাখেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। দুপুর ১টায় নিজের দেওয়া সেই ঘোষণা প্রত্যাহার করে প্রচারে নামেন তিনি। এরপর বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায়সহ সিনিয়র নেতারা আদালত চত্বরে আটক নেতা-কর্মীদের খোঁজখবর নেন এবং রিটার্নিং অফিসারকে সার্বিক পরিস্থিতি অবহিত করেন। নজরুল ইসলাম মঞ্জু অভিযোগ করে বলেন, বুধবার রাত ৮টা থেকে আজ (বৃহস্পতিবার) ভোর ৫টা পর্যন্ত নগরীজুড়ে পুলিশ ও ডিবির সদস্যরা ধানের শীষের নির্বাচনী প্রচারণায় জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের ২১ নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করেন। নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে দিতে সরকার পুলিশবাহিনীকে দিয়ে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছে। ডিবি পুলিশ পরিবারকে হুমকি দিয়েছে নির্বাচনের কাজে যুক্ত থাকলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। জানা যায়, পুলিশ বুধবার গভীর রাতে মহানগরীর গোবরচাকায় নিজ বাড়ি থেকে আটক করে মহানগরী বিএনপির প্রচার সম্পাদক আসাদুজ্জামান মুরাদকে। এর আগে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে মহানগরী যুবদল সভাপতি মাহবুব হাসান পিয়ারু, জেলা ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা তুহিনসহ আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। পরে মহানগরীর কে ডি ঘোষ রোডে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নজরুল ইসলাম মঞ্জু আরও বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরাতে ও নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছে। আওয়ামী লীগ চায় আতঙ্ক তৈরি করে মাঠ ফাঁকা করতে। তাহলে তালুকদার আবদুল খালেকের পক্ষে ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া সহজ হবে। কিন্তু বিএনপি এই নির্বাচনকে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে নিয়েছে। হাজারো নেতা-কর্মী গ্রেফতার হলেও বিএনপি এই নির্বাচন থেকে সরে যাবে না। বরং ওই গ্রেফতারের প্রতিবাদে একদিকে নির্বাচন করবে, অন্যদিকে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করবে। সংবাদ সম্মেলন শেষে দলীয় কার্যালয় থেকে বের হয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আবারও গণসংযোগ শুরু করেন বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের সিনিয়র নেতারা। বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, নিশ্চিত পরাজয়ের শঙ্কায় বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজছে। নেতৃত্বের অযোগ্যতা ও চরম ব্যর্থতার কারণে গত পাঁচ বছর খুলনা মহানগরী সার্বিক উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে পড়েছে। এদিকে অবিলম্বে পুলিশের গ্রেফতার অভিযান বন্ধ না হলে আগামী ৬ মে সিইসির বৈঠক বর্জনের হুমকি দিয়েছে বিএনপি। দলের মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘আমরা বলেছি সিইসি যখন খুলনায় আসবেন, তখন এ ধরনের সংকটের সমাধান করেই যেন তিনি খুলনায় আসেন। আমরা বলেছি, প্রয়োজনে আমাদের সিইসির বৈঠক বর্জন করতে হতে পারে।’

প্রশাসনের বক্তব্য : নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ইউনুচ আলী বলেন, বিএনপির অভিযোগ পাওয়ার পর খুলনা বিভাগীয় কমিশনারকে বিষয়টি অবহিত করেছি। এ ছাড়া খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে বলেছি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, যাদের বিরুদ্ধে মামলা বা ওয়ারেন্ট আছে, তাদের ছাড়া হয়রানিমূলক কাউকে আটক করলে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ কমিশনার সোনালী সেন বলেন, নির্বাচন উপলক্ষে ২০ এপ্রিল থেকে পুলিশের বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও নিয়মিত মামলার আসামিদের আটক করা হচ্ছে। গত রাতে মোট ৩৫ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের জানা মতে বিএনপির নেতা-কর্মী আছেন পাঁচজন। তারা সোনাডাঙ্গা ও দৌলতপুর থানায় দায়ের হওয়া নাশকতা মামলার আসামি।

দুই পুলিশ কর্মকর্তা প্রত্যাহারের দাবি বিএনপির : সিটি নির্বাচনে দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানির মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ দিয়েছে বিএনপি। সেইসঙ্গে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) কমিশনার ও গাজীপুরের পুলিশ সুপারকেও প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে দলটি। গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে এক বৈঠকে বিএনপি প্রতিনিধি দল এসব দাবি তুলে ধরেন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বিকাল ৩টা থেকে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় সিইসির সঙ্গে বৈঠক করেন। বিএনপি প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, বরকত উল্লা বুলু ও যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট মাহবুবউদ্দিন খোকন। আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এ বৈঠকে সিইসি ছাড়াও একজন নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান সাংবাদিকদের বলেন, তফসিল ঘোষণার পর গাজীপুর ও খুলনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও গত দুই দিনে নতুন কার্যক্রম আমরা দেখতে পাচ্ছি। খুলনায় বুধবার নির্বাচনের দায়িত্বরত আমাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, অনেককে ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে, হয়রানি করা হচ্ছে। আমাদের স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য প্রচারণায় অংশ নেওয়ার জন্য খুলনায় গিয়েছেন। তারা যে হোটেলে অবস্থান করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কার্যত সেই হোটেলটি ঘিরে রেখেছে। পুলিশ হোটেলটির ফ্লোরে ফ্লোরে অবস্থান নিয়েছে। আইন অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর সব ক্ষমতার ধারক-বাহক ইসি। কিন্তু পুলিশ যদি সেখানে সমস্যার সৃষ্টি করে, শান্তি-শৃঙ্খলার অজুহাতে ভয়-ভীতি দেখায়, নির্বাচনের প্রচারণায় বাধার সৃষ্টি করে, এই পরিস্থিতিতে কীভাবে সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক ভোট হতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। খুলনায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার দায়দায়িত্ব পুলিশ কমিশনারকে নিতে হবে। আমরা কমিশনের কাছে কেএমপি কমিশনারকে নির্বাচনের সময় প্রত্যাহারের দাবি করেছি। এ সময় মঈন খান গাজীপুরেও তাদের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনী কাজে অংশ নেওয়া বিএনপি নেতা-কর্মীদের ‘বহিরাগত’ হিসেবে উল্লেখ করে অযাচিতভাবে বাধা দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এজন্য আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে গাজীপুরের এসপির প্রত্যাহার চেয়েছি।

সর্বশেষ খবর