বৃহস্পতিবার, ১০ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

খালেদার জামিন আদেশ ১৫ মে আদালতে আবারও হট্টগোল

নিজস্ব প্রতিবেদক

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাই কোর্টের দেওয়া জামিনের বিরুদ্ধে আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ১৫ মে রায়ের  দিন ধার্য করা হয়েছে। গতকাল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ শুনানি শেষে রায়ের দিন ধার্য করে। শুনানিতে কয়েকবার হৈচৈ ও হট্টগোলে জড়িয়ে পড়েন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমর্থক জুনিয়র আইনজীবীরা। পরে সিনিয়র আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। শুনানিতে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, সরকার কার্যত মাইনাস ওয়ান থিউরি নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চায়। এটা অশুভ লক্ষণ। অন্যদিকে জামিনের বিরোধিতা করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল ও দুদকের আইনজীবী। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুব আলম বলেছেন, এই রোগ নিয়েই খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এটা সহনীয় রোগ। খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, খন্দকার মাহবুব হোসেন, মওদুদ আহমদ ও জয়নুল আবেদীন এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। দ্বিতীয় দিনের শুরুতে বিএনপি নেতা মশিউর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমের জামিনের উদাহরণ টেনে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, শুধু এ দুটি মামলায় নয় শতকরা ৯৯.৯৯ ভাগ মামলায় আমাদের বিচার ব্যবস্থায় হাই কোর্টের জামিনে আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেনি। রাষ্ট্র এই মামলাকে অন্য সব মামলার থেকে আলাদা করে এনে দ্রুত বিচার করার চেষ্টা করছে। আমরা মানি বা না মানি গোটা রাষ্ট্রকে এই মামলায় যুক্ত করা হয়েছে। এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপের শামিল। আমি সারা দেশ ঘুরেছি। সারা দেশে আইনজীবীদের মধ্যে ধারণা রয়েছে যে, কোনো মামলায় জামিন হবে কি হবে না, তা নির্ভর করছে বিশেষ ক্লিয়ারেন্সের ওপর। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা বলে লাভ নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল ওই বক্তব্যের আপত্তি জানান। তিনি বলেন, এ কথা সত্য নয়। মোহাম্মদ আলী বলেন, খালেদা জিয়াকে পরিত্যক্ত ও নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছে। তখন সেটা কারাগার ছিল, কিন্তু সেটাকে এখনো কারাগার ঘোষণা করা হয়নি। আমার বলার পর হয়তো সরকার একটা ফাইল তৈরি করে ফেলবে। এভাবেই স্বেচ্ছাচারিতা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা বাড়াতে রিভিশন আবেদন করা হয়েছে। অদৃশ্য দ্রুততার সঙ্গে এ মামলা নিষ্পত্তি করতে চাচ্ছে। এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। এটা প্রত্যাশিত নয়। খালেদা জিয়ার বয়স, শারীরিক অবস্থা ও কম সাজার বিষয় যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়ে হাই কোর্ট জামিন দিয়েছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এবং স্বাভাবিক ধারা অব্যাহত রাখতে এই আদেশ বহাল রাখা হোক। তিনি আরও বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ে অর্থনৈতিক অপরাধ বলা হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক অপরাধ হলে বিচারের জন্য দেশে অন্য আইন আছে। দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় এই অপরাধের বিচারের সুযোগ নেই। পরে খন্দকার মাহবুব শুনানি করেন। তিনি বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ করছি, তারা একটি মামলাও দেখাতে পারবে না যে, হাই কোর্ট জামিন দেওয়ার পর আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেছে। আদালতের ওপরে দোষ চাপিয়ে সরকার কার্যত সরকার ওয়ান থিউরির অংশ হিসেবে খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চায়। এটা অশুভ লক্ষণ। তিনি প্রশ্ন করেন, সারা দেশে লাখ লাখ মামলা থাকার পরেও খালেদা জিয়ার মামলা দ্রুততার সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল কেন শুনানি করতে চান? জয়নুল আবেদীন বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল কোন কর্তৃত্ব বলে বক্তব্য দিয়েছেন। আইন তা অনুমোদন করে না। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, তাহলে আপনারা রাষ্ট্রকে পক্ষ করলেন কেন? জয়নুল আবেদীন জবাব দেন, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, করতে হয় তাই করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিশেষ আইনের মামলা বিশেষভাবেই দেখতে হবে। সরকার ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে এই আপিল করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলা হাই কোর্ট বাতিল করলেও এর বিরুদ্ধে দুদক এবং রাষ্ট্র আপিল বিভাগে আসেনি। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনাসহ সরকারদলীয় অনেক নেতার বিরুদ্ধেই মামলায় হাই কোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্র আপিল করেনি। এর মাধ্যমে সরকার আদালতের ঘাড়ে বোঝা চাপিয়েছে। দুদক এবং সরকার যখন এক হয়ে আপিল করেছে, তখন ন্যায়বিচার নিয়ে আমরা আতঙ্কিত। খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া হলে আজ তার শারীরিক অবস্থার এত অবনতি হতো না। আদালতের জন্য মানুষ না, মানুষের জন্য আদালত। আদালতকে সব কিছুই বইপত্র ছাড়াও আপনাদের আরেকটি চোখ আছে, বিবেক আছে, মন আছে—সবকিছু দিয়ে আপনাদের বিচার করতে হয়। এই আদালতের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের। আমাদেরও দায়িত্ব আছে আপনাদের সহায়তা করার। এ অবস্থায় সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা সমর্থন করা উচিত হবে না। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, সরকারে গেলে আপনারাও তাই করবেন। মওদুদ আহমদ বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ে মূল অভিযুক্ত ও সহযোগী অপরাধী কে তা উল্লেখ করা হয়নি। আপনারা সংবাদপত্র পড়েন। দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, আপনারা দেখেন। খালেদা জিয়া যদি রাজনীতিবিদ না হয়ে সাধারণ নারী হতেন, বিএনপি চেয়ারপারসন না হতেন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না হতেন, তাহলে এই মামলাটি এই পর্যায়ে আসত না। দেশে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, অথচ দুই কোটি টাকার ব্যাপার সরকারের কাছে বড় হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমরা ভিকটিম। আমরা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। আমরা অপরাধ না করলেও মামলা হয়, আর তারা অপরাধ করলেও মামলা হয় না। আইনজীবী এম ইউ আহমেদকে আপনারা জামিন দেননি। এরপর তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। আজ যদি খালেদা জিয়াকে জামিন না দেন, তার যদি কিছু হয়, সরকার তার দায় আপনাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। খুরশীদ আলম খান বলেন, মশিউর রহমানের মামলায় হাই কোর্ট আলাদাভাবে কোনো যুক্তি না দেখানোয় আপিল বিভাগও কোনো যুক্তি দেখায়নি। দুদক কোনো পক্ষপাতিত্ব করছে না। সরকারদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ক্ষেত্রেও আপিল করেছে। নাজমুল হুদার মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় তাকে জামিন দেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যেসব মামলার উদাহরণ দিয়েছেন, প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই আসামি দেড় থেকে দুই বছর কারাভোগ করেছেন। একপর্যায়ে হাই কোর্টের জামিনে আপিল বিভাগের হস্তক্ষেপের নজির চায় আদালত। দুদকের আইনজীবী এ ধরনের নজির দেখাতে না পারলে আইনজীবীদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়। অনেকে হৈচৈ শুরু করেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি শুরু করেন। তিনি বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন এসেছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা প্রশ্ন তুলিনি। জবাবের দরকার নেই। আপনি যুক্তি খণ্ডন করুন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, মশিউর রহমানের মামলা এবং খালেদা জিয়ার মামলার মধ্যে পার্থক্য আছে। এ মামলায় রাষ্ট্রের টাকা চুরি করা হয়েছে। এ পর্যায়ে বিএনপির আইনজীবীরা সমস্বরে প্রতিবাদ জানান। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রের টাকা নিয়ে গিয়েছে এটা বলতে পারব না? এ সময় তীব্র উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। অনেকে আসন থেকে উঠে দাঁড়ান। বিএনপি সমর্থক অনেক আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেলের বিরুদ্ধে নানা তীর্যক মন্তব্য করেন। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থক ও রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তারাও বিএনপির আইনজীবীদের বিরুদ্ধে চেঁচামেচি করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হৈচৈ করে আমাকে কথা বলতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি উত্তেজিত হবেন না, জবাব দিন। অ্যাটর্নি জেনারেল জানান, এ অবস্থায় তার পক্ষে শুনানি করা সম্ভব নয়। চিৎকার চেঁচামেচি বেড়ে গেলে আদালত এজলাস ত্যাগের উদ্যত হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, দলবল নিয়ে এসেছে চাপ সৃষ্টির জন্য। প্রধান বিচারপতি বলেন, উভয়পক্ষের আইনজীবীরা এমন করলে কোর্ট চালানো সম্ভব নয়। পরে সিনিয়র আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই রোগ নিয়েই খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন রাজনীতি করে আসছেন। প্রধান মন্ত্রিত্ব করেছেন। এটা সহনীয় রোগ। এ যুক্তিতে জামিন হতে পারে না। ১৯ মার্চ আপিল বিভাগ খালেদা জিয়াকে হাই কোর্টের দেওয়া জামিনের আদেশ ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত করে। ১২ মার্চ খালেদা জিয়ার আবেদনের শুনানি নিয়ে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাকে চার মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেয় হাই কোর্ট। ওই আদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপক্ষ লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে। শুনানি করে ১৯ মার্চ খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করে আপিল বিভাগ। ৮ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালত খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দেয়। সেদিন থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর