শুক্রবার, ২৭ জুলাই, ২০১৮ ০০:০০ টা
চালক-হেলপারের বর্বরতা

নদীতে না ফেললে বাঁচানো যেত পায়েলকে

মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি

হানিফ পরিবহনের সুপারভাইজার, চালক ও হেলপার নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইদুর রহমান পায়েলকে (২১) জীবিত অবস্থায় নদীতে ফেলে দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ জায়েদুল আলম পিপিএম গতকাল দুপুরে তার কার্যালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন।

পুলিশ সুপার জানান, রোমহর্ষক এই তথ্য দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে হানিফ পরিবহনের সুপারভাইজার জনি (৩৮), চালক জামাল হোসেন (৩৫) ও হেলপার ফয়সাল হোসেন (৩০)। আদালতে এ সময় নিহত পায়েলের সঙ্গে থাকা সহপাঠী দুই বন্ধু মহিউদ্দিন শান্ত ও হাকিমুর রহমান আদরসহ পায়েলের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।

তিনি জানান, গত ২১ জুলাই চট্টগ্রামের বাড়ি থেকে ছুটি কাটিয়ে রাত সোয়া ১০টা দিকে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ৫ম বর্ষের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েল একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম বর্ষের ছাত্র মহিউদ্দিন শান্ত (২২) ও হাকিমুর রহমান আদরের (২২) সঙ্গে হানিফ পরিবহনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব-৯৬৮৭) চড়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ভোর আনুমানিক ৪টার দিকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভাটেরচর এলাকায় পৌঁছালে পায়েল প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গাড়ি থেকে নামার জন্য বাস চালককে বার বার অনুরোধ করেন। এক পর্যায়ে চালক গাড়ি থামালে পায়েল বাস থেকে নেমে প্রস্রাব সেরে বাসে ওঠার আগেই চালক দ্রুত গতিতে বাস ছেড়ে দেন এবং পায়েল বাসের দরজার সঙ্গে প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে মাটিতে পড়ে যান। এতে পায়েলের নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকলে গাড়ি থামিয়ে চালক জামাল, সুপারভাইজার জনি ও হেলপার ফয়সাল তাকে তুলে ভাটেরচর ব্রিজের নিচে নদীতে ফেলে দেন। এ কারণে পায়েলের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ সময় বাসের সব যাত্রী ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন বলে ঘাতকরা স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন। এ ছাড়া ময়নাতদন্ত রিপোর্টেও জানা গেছে, পায়েলের পেটে প্রচুর পানি ছিল, অর্থাৎ তাকে জীবিত অবস্থায় নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

এ ব্যাপারে পায়েলের সহপাঠী মহিউদ্দিন শান্ত জানান, যেহেতু গভীর রাত তাই তারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন এবং এক পর্যায়ে ঘুম থেকে জেগে দেখেন পাশে পায়েল নেই, তার মোবাইলটি সিটে পড়ে আছে। তখন তারা দুই বন্ধু সুপারভাইজারকে পায়েলের কথা জিজ্ঞেস করলে হেলপার সুপারভাইজার এবং চালক তাদের মিথ্যা তথ্য দেন এবং বলেন, পায়েল রাত ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকায় জ্যামে পড়লে বাস থেকে নামে এবং পরের বাসে আসবে বলে জানায়। কিন্তু ঢাকায় অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন পায়েল আর ফিরে আসেনি, তখন তারা পায়েলের আত্মীয়দের বিষয়টি অবগত করেন। পায়েলকে আর খুঁজে না পেয়ে স্বজনরা নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। পুলিশ সুপার জানান, গত ২৩ জুলাই সকালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ভবেরচর খাল থেকে পায়েলের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় পায়েলের স্বজনরা কোনো প্রকার মামলা ছাড়া মৃতদেহ নিয়ে চলে যেতে চাইলেও মরদেহের সুরতহাল দেখে পুলিশ অনুরোধ করে মামলা করার জন্য। পরে পুলিশের অনুরোধে ২৪ জুলাই বাসচালক জামাল, সুপারভাইজার জনি ও হেলপার ফয়সাল হোসেনকে আসামি করে গজারিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন পায়েলের মামা গোলাম সরোয়ার্দী বিপ্লব। এ ঘটনায় পুলিশ ওই তিনজনকে আটক করতে সক্ষম হয় এবং রোমহর্ষক এ ঘটনাটি আবিষ্কার করে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার জানান, হানিফ পরিবহনের ওই বাসটিকে আটক করে আদালতের কাছে সোপর্দ করা হবে। এই পরিবহনের কর্তৃপক্ষকেও জবাব দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে সুপারিশ করা হবে। তিনি বলেন, সুপারভাইজার, হেলপার এবং ড্রাইভার তিনজনই একজোট হয়ে একটি মেধাবী ছাত্রকে যেভাবে মর্মান্তিভাবে হত্যা করেছে, তার দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করাই হবে পুলিশের কাজ। প্রসঙ্গত, নিহত সাইদুর রহমান পায়েল চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ থানার হরিষপুর গ্রামের গোলাম মওলার ছেলে। অপরদিকে হানিফ পরিবহনের ঘাতক সুপারভাইজার জনি খুলনা জেলার খানজাহান আলী থানার শিরোমনি শাহবাড়ি গ্রামের ইসমাইলের ছেলে এবং চালক জামাল হোসেন ও হেলপার ফয়সাল হোসেন আপন দুই ভাই। তারা খুলনা জেলার বটিয়াঘাট থানার তেঁতুলতলা গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। তারা ৩ জনই এখন মুন্সীগঞ্জের জেলা কারাগারে রয়েছেন।

সর্বশেষ খবর