শিরোনাম
শনিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর ‘ওথেলো সিনড্রোম’

মির্জা মেহেদী তমাল

ভয়ঙ্কর ‘ওথেলো সিনড্রোম’

১৬০৪ সাল। প্রথম মঞ্চস্থ করা হয় উইলিয়াম  শেকসপিয়রের নাটক ‘ওথেলো’। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিল ‘ওথেলো’ যে তার স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে থাকত সবসময় এবং ধীরে ধীরে এই ভয়ের পরিণতিটা গিয়ে ঠেকল সন্দেহে। তার স্ত্রী ছিল অত্যন্ত রূপবতীদের একজন। সে আস্তে আস্তে তার স্ত্রীকে অসতী হিসেবে সন্দেহ করতে থাকলেন। মূলত নাটকের কাহিনীটা শর্টকার্টে এরকমই ছিল। আর গল্পের শেষে ওথেলোর হাতেই মৃত্যু হয়েছিল তার স্ত্রীর। শেকসপিয়রের এই গল্পের ঘটনাটা শুধুই একটি গল্প নয়। এটা ভয়ানক একটি রোগ। শেকসপিয়রের নাটকের সঙ্গে মিল রেখেই এর নাম রাখা হয়েছিল ‘ওথেলো সিনড্রোম’ বেশিরভাগ সময় পুরুষরা এই রোগে আক্রান্ত হয়। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে শুরু হয় সন্দেহ। নেশাগ্রস্তরা সহজেই এই রোগে আক্রান্ত হয়। একপর্যায়ে স্ত্রীর জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। এমন ঘটনা এখন ঘরে ঘরে। এমনই এক পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল রায়হান পরিবার।

রায়হান কবির ব্যবসায়ী। ব্যবসা সংক্রান্ত কাজের চাপে রাত করে তাকে বাসায় ফিরতে হয়। ঘরে সুন্দরী স্ত্রী লুনা স্বামীর অপেক্ষায় জেগে থাকেন ততক্ষণ। প্রায় দেড় বছর ওদের বিয়ে হয়েছে। এখনো সন্তান নেননি ওরা। রায়হান বেশির ভাগ সময় মদপান করেই বাসায় আসেন। স্বামী বলতে অজ্ঞান লুনা। স্বামীর এ দোষটিকে তাই তিনি মেনেই নিয়েছেন। সেদিন ছিল লুনার জন্মদিন। ভেবেছিলেন স্বামী তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন। দুজনে একসঙ্গে বাইরে গিয়ে চাইনিজ খাবেন। সন্ধ্যা থেকেই সাজতে বসেছিলেন লুনা। এমনিতেই তিনি যথেষ্ট সুন্দরী, সাজগোজ করার পর তাকে স্বর্গের অপ্সরি বলে মনে হলো। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। অপেক্ষা করতে করতে সময় বয়ে গেল। নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়লেন সাজগোজ করা অবস্থাতেই। মাঝরাতে ফিরলেন রায়হান। অনেকক্ষণ ধরে কলিং বেল টেপার পর ঘুম ভাঙল লুনার। দরজা খুললেন। স্ত্রীকে এমন সাজগোজ করা অবস্থায় দেখে এবং দরজা খুলতে দেরি হওয়ার কারণে রায়হান চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুললেন। তার ধারণা হলো এতক্ষণ লুনা কোনো পরপুরুষের সঙ্গে শুয়েছিলেন, দরজা খুলতে দেরি হওয়ার সেটাই কারণ। লুনাকে পেটাতে লাগলেন। অনেক দিন ধরেই লুনাকে সন্দেহ করছিলেন। আজ প্রমাণ পেয়েছেন, যদিও পুরুষটিকে হাতেনাতে ধরতে পারেননি। ধরতে পারেননি তো কী হয়েছে, লুনার সাজগোজ এবং বিলম্বে দরজা খোলাটাই সবচেয়ে বড় প্রমাণ। পেটানোর একপর্যায়ে লুনা অজ্ঞান হয়ে গেলেন। মাথা কেটে গেল, রক্তে মেঝে ভিজতে লাগল। তাতেও ক্ষান্ত হলেন না রায়হান। লুনার কাপড়চোপড় খুলে ফেললেন। লুনার নগ্ন শরীরটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন, সেখানে পুরুষের আদরের কোনো চিহ্ন আছে কি না। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিন লুনাকে নির্যাতন করতেন রায়হান। কার সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক রয়েছে তা জানার জন্য ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। জোর করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করতে চাইতেন দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে। একদিন লুনা একজন চিকিৎসককে ফোন করে তার স্বামীর ব্যাপারটি জানালেন। চিকিৎসক সব শুনে তাকে জানান যে, রায়হান ‘ওথেলো সিনড্রোমের’ শিকার হয়েছেন। দ্রুত চিকিৎসা দরকার। অবশ্যই রায়হানকে মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে, নইলে ‘ওথেলো সিনড্রোম’ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে স্ত্রীর সতীত্বের প্রতি সন্দেহ থেকে এবং সেগুলো বিশ্বাস করাকেই ‘ওথেলো সিনড্রোম’ বলে। সাধারণত পুরুষরা এই রোগে বেশি ভোগেন। তবে অনেক মহিলার মধ্যেও ‘ওথেলো সিনড্রোম’ দেখা যায়। নামটি এসেছে উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটক ‘ওথেলো’ থেকে। ‘ওথেলো সিনড্রোমে’র রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে চান না। নিজেকে সব সময় সুস্থ মনে করেন। নিজের ধারণাটিকে প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন। এই মিথ্যা অলীক বিশ্বাসের কারণে অনেক সময় এসব রোগী তাদের স্ত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করেন।

বিভিন্ন কারণে এই রোগ হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে— ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতা, সিজোফ্রেনিয়া, মদে আসক্তি প্রভৃতি। এ ছাড়া কিছু শারীরিক অসুখের কারণেও ‘ওথেলো সিনড্রোম’ হতে পারে। যেমন, মস্তিষ্কে টিউমার, এন্ডোক্রাইন ও বিপাক ক্রিয়ার ত্রুটি প্রভৃতি।

স্ত্রীর সতীত্বের প্রতি তীব্র সন্দেহবোধ হলো রোগের প্রধান উপসর্গ। রোগী মনে করেন তার স্ত্রী গোপনে অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করেন। তার মধ্যে একধরনের আতঙ্ক কাজ করে। খাবারের প্রতি অনীহা আসে। স্ত্রীর অসততা প্রমাণ করার জন্য গোপনে স্ত্রীর প্রতি নজর রাখেন। স্ত্রীর কাপড়চোপড় গোপনে পরীক্ষা করেন। গোপনে স্ত্রীর ডায়েরি ও কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেন। স্ত্রীর নামে কোনো চিঠি এলে তা সরিয়ে ফেলেন। স্ত্রীর চারিত্রিক কল্পিত অসততার কথা আত্মীয়-স্বজনকে বলেন। পদে পদে স্ত্রীকে হেয় করতে চান। স্ত্রী অপমানিত হলে মনে মনে খুশি হন। স্ত্রীকে নানাভাবে নির্যাতন করেন। জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চান। রোগী নিজেকে সব সময় অপূর্ণ মনে করেন। তার বিশ্বাস জন্মায় যে, স্ত্রী তার অর্জিত টাকাপয়সা অবৈধ প্রণয়ের পেছনে খরচ করে তাকে নিঃস্ব করতে চান।

 এসব চিন্তা করে তার স্ত্রীকে নির্যাতনের মাত্র আরও বাড়িয়ে দেন। দুশ্চিন্তায় রোগীর স্বাস্থ্যহানি ঘটে। অনিদ্রা দেখা দেয়। মদে বা অন্য নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। স্ত্রী সন্তান প্রসব করলে সেই সন্তানকে অবৈধ সন্তান মনে করে সন্তানকেও তিনি নির্যাতন করে থাকেন। স্ত্রী ও সন্তানের প্রতি তার প্রচণ্ড ঘৃণা জমে উঠতে থাকে।

চিকিৎসকরা বলছেন, ‘ওথেলো সিনড্রোম’ চিকিৎসা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। চিকিৎসক স্ত্রী ও স্বামী দুজনের সঙ্গে পৃথক পৃথক কথা বলেন এবং তাদের কথা শোনেন। দাম্পত্য জীবনের বিস্তারিত বিবরণ জানাটা অপরিহার্য। রোগীর বিশ্বাসের ভিত্তি এবং স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে হবে। রোগীকে বিশেষ মাত্রায় অ্যান্টি সাইকোটিক ওষুধের পাশাপাশি ‘বিহেভিয়ার থেরাপি’ প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। রোগীর অন্য কোনো অসুখ আছে কিনা, তাও ভালোমতো দেখতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর