বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
রোহিঙ্গা গণহত্যা

বিস্তর আলোচনা করলেও নিরাপত্তা পরিষদ শাস্তি দান করেনি!

প্রতিদিন ডেস্ক

জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, ধর্ষণ ও ৭ লাখের বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা— বহুল আলোচিত এসব নৃশংসতা উঠে এলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদ সুনির্দিষ্ট শাস্তিদানের পদক্ষেপ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ জানায়, বক্তারা ওই প্রতিবেদনের উল্লেখ করলেও এমনকি মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস নিজে একবারও ‘গণহত্যা’ শব্দটি উচ্চারণ করেননি। নিউইয়র্ক থেকে এনআরবি নিউজ জানায়, রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ উন্মুক্ত ব্রিফিং করেছে। এর আয়োজক নিরাপত্তা পরিষদের চলতি আগস্টের সভাপতি যুক্তরাজ্য। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস, ইউএনডিপির অ্যাসোসিয়েট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর তেগেগনিঅর্ক গেট্টু ও ইউএনএইচসিআরের শুভেচ্ছাদূত অস্কারজয়ী অভিনেত্রী কেইট ব্লানচেট। সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারিক মাহমুদ আহমাদ। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারও বক্তব্য দেয়। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, তিনি মনে করেন, আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদনের ফলাফল ও সুপারিশ জাতিসংঘে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার গুরুত্বের বিবেচনার দাবি রাখে। (ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ২৭ আগস্ট)। প্রতিবেদনে আইন প্রয়োগের নামে ভয়ঙ্কর ওই অপরাধ সংঘটনের জন্য মিয়ানমারের সেনাপ্রধান এবং জ্যেষ্ঠ পাঁচ জেনারেলকে বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করা হয়েছে। মিয়ানমার ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ‘গণহত্যার অভিপ্রায়’ থেকেই রাখাইনের অভিযানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। আর মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চির বেসামরিক সরকার ‘বিদ্বেষমূলক প্রচারকে উসকে’ দিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ ‘আলামত ধ্বংস’ করে এবং সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষা না করে সেই নৃশংসতায় ‘ভূমিকা’ রেখেছে। ব্রিফিং অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস গত জুলাইয়ে তার কক্সবাজার সফরের সময় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের মর্মস্পর্শী বর্ণনা উপস্থাপন করেন। গুতেরেস বলেন, ইতোমধ্যে এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সমস্যা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না। নিরাপত্তা পরিষদ প্রেসিডেনশিয়াল স্টেটমেন্ট গ্রহণে একতা দেখিয়েছিল। এ একতা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন যদি আমরা যথাযথ কাজের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দাবি পূরণ করতে চাই। তিনি কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা পুনরুল্লেখ করে জাতিসংঘ ও এর বিভিন্ন সংস্থাকে রাখাইন প্রদেশে বাধাহীন প্রবেশাধিকার দিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনা অভিযানে দমন-পীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গার ঢল। কয়েক মাসেই শরণার্থীর সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়ে যায়। রাখাইনে অভিযানকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ হিসেবে মিয়ানমার তুলে ধরতে চাইলেও জাতিসংঘ একে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবেই দেখছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন এক বছর ধরে রোহিঙ্গা ইস্যু সামনে রেখে সমাধানে কাজ করে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ধন্যবাদ জানান। রাষ্ট্রদূত বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের পদক্ষেপসমূহের টেকসই বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও উদারভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দেবে।

বাংলাদেশের চার দফা : রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমার কর্তৃক চরটি আশু পদক্ষেপ বাস্তবায়নের সুপারিশ করেন। এগুলো হচ্ছে— ১. রাখাইন প্রদেশের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম ও শহরগুলোয় প্রয়োজনীয় মানবিক ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআরকে বাধাহীনভাবে প্রবেশাধিকার দিতে হবে, যা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২. বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে আটকে থাকা কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়া এবং ফেরত না নেওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষ থেকেই তাদের মানবিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। ৩. রাখাইন রাজ্যের আইডিপি ক্যাম্প উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং সেখানে আটক মানুষেরা যাতে নিজ বাসভূমিতে বা তাদের অন্য কোনো পছন্দনীয় স্থানে পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে টেকসইভাবে প্রত্যাবর্তন করতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪. রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশ্বাস ও পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং হিংসা উদ্রেককারী বক্তব্য ছড়ানো যা সহিংসতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে তা দমন করতে হবে।

মিয়ানমারের মায়াকান্না : মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হাউ দু সুয়ান তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তার সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের মায়াকান্নার প্রতিচ্ছবির প্রকাশ ঘটে রাষ্ট্রদূত এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলার ঘটনার মধ্য দিয়ে, যা ছিল কূটনীতিক শিষ্টাচার পরিপন্থী। রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর মিয়ানমার প্রশাসনের বর্বরতার রোমহর্ষক ঘটনাবলি ধামাচাপা দিতে মিয়ানমারের এই রাষ্ট্রদূতের মেকি কান্নায় ‘চিঁড়া ভেজেনি’ বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন।

সর্বশেষ খবর